শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১

বজ্রঝড়ে ১২ জনের প্রাণহানি

গাছপালা ভেঙে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ঘরবাড়ি, দোকান ও ফসলের ক্ষেত। মহাসড়কে গাছ পড়ে বিঘ্নিত হয় যান চলাচল। বিদু্যৎহীন হয়ে পড়ে বহু এলাকা
যাযাদি ডেস্ক
  ০৮ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
রোববার পিরোজপুরের কাউখালীতে কালবৈশাখী ঝড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ঝড়ে গাছ ভেঙে তার ছিঁড়ে বিচ্ছিন্ন হয় বিদু্যৎ সরবরাহ -ফোকাস বাংলা

কালবৈশাখী ঝড়ে গাছপালা ভেঙে ও বজ্রপাতে সারাদেশে অন্তত ১২ জনের মৃতু্য হয়েছে। আহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন। এর মধ্যে অধিকাংশ মৃতু্য হয় দক্ষিণাঞ্চলে। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অসংখ্য ঘরবাড়ি, দোকান ও ফসলের ক্ষেত। মহাসড়কে গাছ পড়ে বিঘ্নিত হয় যান চলাচল। বিদু্যৎহীন হয়ে পড়ে বহু এলাকা।

রোববার সকালে হঠাৎ শুরু হয় দমকা হাওয়াসহ ঝড়। সঙ্গে চলে বজ্র ও বৃষ্টি। কয়েক মিনিটের স্থায়ী এ ঝড়ে ঝালকাঠি সদর ও কাঠালিয়ায় ৩, ভোলার মনপুরা ও লালমোহনে ২, পটুয়াখালীর বাউফলে ২, পিরোজপুর, নেত্রকোনা, বাগেরহাট ও খুলনার ডুমুরিয়ায় একজন করে প্রাণ হারায়। অন্যদিকে শনিবার দিবাগত রাতে ঝড়ের কবলে পড়ে আহত একজন রোববার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থা মারা যান।

আমাদের ঝালকাঠি প্রতিনিধি জানান, ঝড়ের সময় বজ্রপাতে হেলেনা বেগম ও মিনারা বেগম নামে দুই নারী এবং মাহিয়া আকতার ঈশানা নামে এক শিশুর মৃতু্য হয়েছে। রোববার জেলার কাঁঠালিয়া ও সদর উপজেলায় সকাল ১০টার দিকে এ ঘটনা ঘটে।

আধা ঘণ্টাব্যাপী তান্ডব চালানো এই বজ্রসহ ঝড়ে জেলার চার উপজেলায় শতাধিক বসতঘর ভেঙে পড়েছে। এ সময় গাছপালারও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

ঝালকাঠি সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শহিদুল ইসলাম জানান, বজ্রপাতে সদর উপজেলায় পোনাবালিয়া ইউনিয়নে ঈশানা নামের এক শিশু ও শেখেরহাট ইউনিয়নে মিনারা বেগম নামের এক গৃহবধূর মৃতু্য হয়েছে।

কাঁঠালিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাসির উদ্দিন সরকার জানান, বজ্রপাতে উপজেলার মুন্সিরাবাদ গাজীবাড়ি এলাকায় গরু আনতে গিয়ে হেলেনা বেগম নামে এক নারীর মৃতু্য হয়েছে। হেলেনা মুন্সিরাবাদ গাজিবাড়ি গ্রামের মৃত আলম গাজির স্ত্রী ও মিনারা বেগম ঝালকাঠি সদর উপজেলার শেকেরহাট গ্রামের বাসিন্দা ফারুক হোসেনের স্ত্রী। এ ছাড়া পোনাবালিয়া গ্রামে গরু আনতে গিয়ে ঈশানা নামে এক শিশুর মৃতু্য হয়।

ভোলা প্রতিনিধি জানান, জেলার মনপুরা ও লালমোহনে প্রায় দুই শতাধিক ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিধ্বস্ত হয়েছে বিপুল সংখ্যক গাছপালা। ঝড়ের কবলে পড়ে দুইজন নিহত হয়েছেন। এছাড়া মনুপরার দাসের এলাকায় ছয় জেলেসহ একটি মাছ ধরার ট্রলার ডুবে গেছে।

রোববার দুপুরে ঘূর্ণিঝড়ের এ ঘটনা ঘটে। এ সময় ঘরচাপায় হারেস (৬৮) এবং বজ্রপাতে বাচ্চু (৪০) নামে দুইজন নিহত হয়েছেন।

স্থানীয়রা জানান, দুপুর ১২টায় ঝড়ে মনপুরার হাজির হাট ইউনিয়নের দাসেরহাট ও দক্ষিণ সাকুচিয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে প্রায় ১০০ কাঁচা ঘরবাড়ির ক্ষতি হয়েছে। ঝড়ে অধিকাংশ ঘরের চাল বেড়া উড়ে যায়। এ সময় দাসের হাটের মেঘনায় মাছ ধরা অবস্থায় ছয় জেলেসহ একটি ট্রলার ডুবে যায়। তবে অন্য ট্রলারের সহায়তায় তাৎক্ষণিক সবাইকে জীবিত উদ্ধার হলেও ট্রলারটি পাওয়া যায়নি। এছাড়াও ঝড়ে দুই শতাধিক ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে।

ভোলার জেলা প্রশাসক আরিফুজ্জামান জানান, নিহতের পরিবারকে নগদ ২৫ হাজার টাকা করে ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হবে। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত তিন উপজেলায় ১৬ টন চাল তাৎক্ষণিক বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

আমাদের বাউফল (পটুয়াখালী) প্রতিনিধি জানান, ঝড়ের তান্ডবে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এ সময় রাতুল (১৪) নামের এক কিশোর ও সুফিয়া বেগম (৮৫) নামের এক বৃদ্ধা নিহত হয়েছেন। নিহত রাতুল উপজেলার নাজিরপুর ইউনিয়নের রায় তাঁতের কাঠি গ্রামের জহির সিকদারের ছেলে। তাকে রাস্তায় মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।

ধারণা করা হচ্ছে বজ্রপাতে সে মারা গেছে। আর সুফিয়া বেগম দাশপাড়া ইউনিয়নের চরআলগী গ্রামের মৃত আহম্মেদ প্যাদার স্ত্রী। ঘরের ওপর গাছ পড়ে তিনি মারা যান।

এ ছাড়া উপজেলার গোসিংগা গ্রামের আফসেরের গ্রেজ এলাকায় ঘরের ওপর গাছ ভেঙে পড়ে মা সাবিহা (৩০), তার মেয়ে ইভা (১২) ও দুই বছর বয়সি তাকে শিশু মারাত্মক আহত হয়েছে।

রোববার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বেলা ১১টা ৫ মিনিট পর্যন্ত ৩৫ মিনিট এ ঝড় স্থায়ী হয়। এতে বাউফলের বিভিন্ন এলাকা থেকে শতাধিক আধাপাকা বাড়ি বিধ্বস্ত হয়। এ সময় ব্যাপক শিলাবৃষ্টি ও বজ্রপাত হয়েছে।

এদিকে বাউফল পৌর শহরের থানার সামনে সালেহিয়া ফাজিল মাদ্রাসার একটি ভবনের টিনের চালা উড়ে রাস্তায় পড়ে যানবাহন চলাচল বেশ কিছু সময় ধরে বন্ধ ছিল। এ ছাড়া পশু হাসপাতাল রোডে গাছ ভেঙে সড়কের ওপর পড়ায় সেখানেও চলাচলে বিঘ্ন ঘটে। বিভিন্ন এলাকায় খুঁটি ভেঙে পড়ে। শিলাবৃষ্টিতে তরমুজসহ রবি ফসল ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বশির গাজী বলেন, ঝড়ে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের জন্য কৃষি বিভাগ ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

আমাদের পিরোজপুর প্রতিনিধি জানান, কালবৈশাখী ঝড়ে বসতঘরের ওপর গাছ ভেঙে পড়ে এক গৃহবধূর মৃতু্য হয়েছে। গুরুতর আহত হয়েছে তাঁর ছয় বছরের মেয়ে। রোববার সকালে পিরোজপুর পৌরসভার মরিচাল গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।

মৃত রুবী বেগম পিরোজপুর পৌরসভার মরিচাল গ্রামের মিরাজ সরদারের স্ত্রী। ঝড়ে আহত এ দম্পতির মেয়ে মাহাজেবিনকে (৬) উন্নত চিকিৎসার জন্য খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। এছাড়া গাছপালার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। গাছ চাপা পড়ে অসংখ্য বসতঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

স্থানীয়রা জানান, পৌরসভার মরিচাল গ্রামে বসতবাড়ির ওপর গাছ ভেঙে পড়লে রুবী বেগম ও তার মেয়ে মাহাজেবিন আহত হন। স্থানীয় লোকজন তাদের উদ্ধার করে পিরোজপুর সদর উপজেলা হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক রুবী বেগমকে মৃত ঘোষণা করেন।

সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আরিফ মুর্শেদ বলেন, 'ঝড়ে এক নারীর মৃতু্য ও অর্ধশত বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার তথ্য পেয়েছি।

\হনেত্রকোনা প্রতিনিধি জানান, জেলার খালিয়াজুরীতে শহিদ মিয়া (৫২) নামে এক কৃষক নিহত হয়েছে। রোববার সকালে উপজেলার মেন্দিপুর ইউনিয়নের রাজঘাট নামক এলাকায় এই ঘটনাটি ঘটেছে। নিহত শহিদ মিয়া উপজেলার ওই ইউনিয়নের জগন্নাথপুর গ্রামের মৃত কফিল উদ্দিনের ছেলে।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, রোববার সকাল আনুমানিক সাড়ে ১১টার দিকে উপজেলার একটি হাওড়ে রাজঘাট এলাকায় নিজ জমিতে কাঁচা মরিচের পরিচর্যা করছিলেন শহীদ মিয়া। এসময় হঠাৎ বজ্রপাত হলে ঘটনাস্থলেই মারা যান তিনি। পরে খবর পেয়ে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে নিজ বাড়িতে নিয়ে যায়।

খালিয়াজুরী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) খোকন কুমার সাহা জানান, খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠানো হয়েছে। আইনি প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।

বাগেরহাট প্রতিনিধি জানান, জেলায় কালবৈশাখী ঝড়ে একজন নিহত ও ১০ জন আহত হয়েছেন। এসময় ঝড়ে দেড় শতাধিক ঘর বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সদর উপজেলার পুটিমারি, রাধাবলস্নভ, গোবরদিয়া, ডেমা, বাঁশবাড়িয়া ও কচুয়াসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে এই ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

এ ছাড়া বাগেরহাট টার্মিনাল এলাকায় ঝড়ে বিলবোর্ড পড়ে একটি বাস ও ৫টি দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং দুইজন বাস শ্রমিক আহত হয়েছে। ঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে কাজ করা হচ্ছে বলে জানান জেলা প্রশাসক।

রোববার দুপুরে বাগেরহাট সদর উপজেলার রাধাবলস্নব বেড়িবাঁধ এলাকায় সরজমিনে দেখা যায়, বাঁধের পাশে আশ্রয় নেয়া তারা বানু খোলা আকাশের নিচে সন্তানদের নিয়ে বসে আছেন। তার ভাষায়, মুহূর্তের মধ্যেই ঘর উড়িয়ে নিয়ে সব শেষ করে দিয়েছে। এখন ঘরের পোতা ছাড়া কিছু নেই, কি করব, কোথায় যাব জানি না।

বাগেরহাট পৌরসভার সোনাতলা এলাকার বাসিন্দা আবুল কালাম আজাদ বলেন, পৌনে দশটার দিকে হঠাৎ মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। মুহূর্তের মধ্যে চারদিকে অন্ধকার নেমে আসে। এরপরই প্রচন্ড বাতাস, ঝড়ো হওয়া ও বৃষ্টি শুরু হয়। এতে বেশকিছু গাছপালা ভেঙ্গে পড়ে। ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

ডেমা এলাকায় রিয়াদ হোসেন বলেন, মুহূর্তের ঘরের চাল সব কিছু ঝড়ে উড়ে গেছে এখন খোলা আকাশে রয়েছি। কয়েকদিন পর ঈদ কি করব কিছু বুঝতে পারছি না। সরকারের সহায়তা না পেলে এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারব না।

বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক খালিদ হোসেন বলেন, আকস্মিক ঝড়ে বেশকিছু ঘরবাড়ির ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গাছপালা উপড়ে পড়েছে ক্ষতিপূরণ নিরূপণের জন্য সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে তালিকা পেলেই ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।

ডুমুরিয়া (খুলনা) প্রতিনিধি জানান, খুলনার ডুমুরিয়ায় ঝড়ের বজ্রপাতে ওবায়দুলস্নাহ (৩১) নামে এক কৃষক মারা গেছে। রোববার সকালে কানাইডাঙ্গা বিলে গরুর ঘাস কাটতে গিয়ে তিনি বজ্রপাতে মারা গেছেন। স্থানীয় ইউপি সদস্য মেহেদী হাসান মিন্টু এতথ্য নিশ্চিত করেছেন। কৃষক ওবায়দুলস্নাহ গাজী গুটুদিয়া ইউনিয়নের কোমলপুর গ্রামের দেলোয়ার গাজীর ছেলে।

সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, কালবৈশাখী ঝড়ের কবলে আহত যুবক মো. আক্তার হোসেন (৩৫) চিকিৎসাধীন অবস্থায় সিলেট রাগীব রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃতু্যবরণ করেছেন।

\হশনিবার রাত সাড়ে ৩টার দিকে হাসপাতালে নিবিড় পর্যবেক্ষণে থাকা অবস্থায় তার মৃতু্য হয়েছে বলে জানিয়েছে পরিবার। নিহত যুবক সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার লক্ষণশ্রী ইউনিয়নের কলাইয়া গ্রামের মৃত আফিছ আলীর ছেলে। তিনি কলাইয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দপ্তরি কাম অফিস সহায়ক পদে কর্মরত ছিলেন।

জানা যায়, গেল ৩১ শে মার্চ রাতে সিএনজিযোগে সিলেট থেকে সুনামগঞ্জ আসার পথে সাড়ে ১০টার দিকে শান্তিগঞ্জ উপজেলার পাগলাবাজার এলাকায় কালবৈশাখী ঝড়ের কবলে আটকা পড়েন তিনি। এসময় ঝড়ের গতিবিধি দেখতে সিএনজি থেকে বের হলে প্রচন্ড ঝড়ে গাছের ডাল পড়ে গুরুতর আহত হন আক্তারুজ্জামান। স্থানীয়দের সহযোগিতায় আশঙ্কাজনক অবস্থায় সিলেট রাকিব রাবেয়া মেডিকেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে নিবিড় পর্যবেক্ষণ রাখা হয় তাকে। সর্বশেষ গত শনিবার রাতে অবস্থা অবনতি হলে রাত সাড়ে তিনটার দিকে মৃতু্যবরণ করেন তিনি।

নিহতের ভাই হুমায়ূন কবির বলেন, আমার চাচাতো ভাই আক্তার সেদিন পাগলা এলাকায় কালবৈশাখী ঝড়ে গাছ পড়ে আহত হন। ৭ দিনের মতো সিলেট রাকিব রাবেয়া মেডিকেলে চিকিৎসাধীন থাকার পর শনিবার রাতে তার মৃতু্য হয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে