সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

ভরা মৌসুমেও হাওড়ে দেশীয় মাছের অভাব

সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে অবৈধ জাল দিয়ে মা ও পোনামাছ ধরা হলেও নজরদারি নেই
স্বদেশ ডেস্ক
  ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০

কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও হবিগঞ্জের সংযোগস্থল নিয়ে বিস্তীর্ণ হাওড়াঞ্চল। বর্তমানের মাছের ভরা মৌসুম চললেও পাওয়া যাচ্ছে না দেশীয় প্রজাতির মাছ। মাঝে মধ্যে যদি পাওয়া যায়, তাও সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। একদিকে হাওড়গুলোতে পানির অভাব, অন্যদিকে, অবৈধ জাল দিয়ে মাছ নিধনের কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। এ বিষয়ে আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে বিস্তারিত ডেস্ক রিপোর্ট-

হাওড়াঞ্চল প্রতিনিধি জানিয়েছেন, কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম, মিঠামইন, ইটনা, নিকলী, হবিগঞ্জের আজমেরিগঞ্জ, লাখাই, বানিয়াচং, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, সরাইল, সুনামগঞ্জের দিরাই, শালস্না, নেত্রকোনা মোহনগঞ্জ, মদনসহ পার্শ্ববর্তী উপজেলার বাজারগুলোতে এই ভরা মৌসুমে দেশীয় প্রজাতির মাছের অভাব দেখা দিয়েছে। তাই বর্তমানে পুকুরের চাষ করা মাছ অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিক্রি হচ্ছে।

জানা গেছে, এক সময় এ হাওড়াঞ্চলের উপজেলাগুলোয় দেশীয় মাছ প্রচুর পাওয়া যেত, যা স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে জাতীয় পর্যায়ে রপ্তানি করা হতো। এখন আর তা হয় না বললেই চলে। মাছের দুর্মূল্য ও দুষ্প্রাপ্যতায় হাওড় অধু্যষিত উপজেলাগুলোর সাধারণ মানুষ প্রয়াজনীয় পুষ্টি গ্রহণে ব্যর্থ হচ্ছে। খামারের মাছই এখন বাজার দখল করে ফেলেছে। হাওড় উপজেলা থেকে প্রায় ৫০ প্রজাতির দেশীয় মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আরও বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বিলুপ্তির পথে বলে স্থানীয় প্রবীণ জেলেদের ভাষ্য।

এক সময় দেশের মৎস্য ভান্ডার হিসেবে পরিচিত হাওড় উপজেলাগুলোতে অগনিত নদী বিল-বাদার, খাল-বিলে পরিপূর্ণ ছিল। মিঠা পানিতে পরিপূর্ণ এ হাওড় উপজেলায় প্রায় ২৫০ প্রজাতির দেশীয় মাছ পাওয়া যেত। দেশ-বিদেশের লোকজন এসে মাছ শিকার এবং মাছের তৈরি সুস্বাদু খাবার খেয়ে পরিবারের লোকজনের জন্য মাছ নিয়ে যেতেন। এমন কি এই মাছ ধরে বিক্রি করে সংসার চালাতেন হাওড় পাড়ের জেলেরা। কিন্তু এখন আর তা নেই। নদীগুলোর নাব্য হ্রাস, খাল-বিল ভরাট করে কৃষিজমি অথবা বাড়িঘর তৈরি, জলমহালগুলোতে ইজারাদারদের স্বেচ্ছাচারিতা, মাছের অভয়াশ্রমের পার্শ্ববর্তী জমিতে কীটনাশকের ব্যবহারে মৎস্য সম্পদ উজার হয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও অপরিকল্পিতভাবে নদীতে বাঁধ দিয়ে মাছের চলাচলে বাধা সৃষ্টি, সেচ প্রকল্প বাস্তবায়ন, বিষ প্রয়োগ, পাটি বাঁধ ও বিলের পানি সেচের মাধ্যমে মাছ আহরণ, কারেন্ট জাল মশারি জালসহ নিষিদ্ধ জাল দিয়ে মাছ ধরা, রেণুপোনা ও মাছ ধরার কারণে এ হাওড়াঞ্চলের মৎস্য সম্পদ ধংস হচ্ছে বলে স্থানীয়রা জানান। ফলে বর্ষার মৌসুমেও দেশীয় প্রজাতির মাছের প্রচুর আকাল।

এসব মাছের মধ্যে রয়েছে নানিদ মাছ, মাগুর, টাকি, কৈ, শিং, বাতাসি, গুং, রানি, পান, রিডা, খলিশা, বইছা, কানলা, বামট, পাপদা, চং, বাগাড়, বংরা, সিলুন, খলা, লাচু, এলগন, রামচেলা, গিলাকানি, নাপিত ও গলদা চিংড়িসহ অসংখ্য প্রজাতির মাছ। এছাড়াও বিলুপ্তির পথে রয়েছে ইলিশ, মলা, রুই, কাতলা, বজরি, হালনি, ডানকানা, গুতুম, পুঁটি, চাঁদা, ডিমা চিংড়ি, বাইম ও মনি মাছ।

হাওড় অধু্যষিত উপজেলার অষ্টগ্রাম, আব্দুলস্নাপুর, আদমপুর, মোহনতলা, ইকুরদিয়া, বাংগালপাড়া, সাভিয়ানগর, পূর্ব অষ্টগ্রাম, মিঠামইনের ঘাগড়া, ঢাকী, সদর, ইটনার, এলংজুরি, ধনপুর, জয়সিদ্ধি, আজমরি, পাহারপুর, বদলপুর, কাকাইলচেও, নতুনবাজার, ইকরাম, বিথলংবাজার, লাখাইবাজার, বামৈর বাজার, মুড়াকুড়ি, চাতলপাড়, গোয়ালনগরসহ হাওড়ের বিভিন্ন হাট-বাজার ঘুরে দেখা গেছে, এই বর্ষায় মাছের মৌসুমেও দেশীয় প্রজাতির মাছের অভাবে পুকুর চাষের মাছে বাজার ভরপুর। মাঝে মধ্যে যদিও নদী বা হাওড়ের দেশীয় প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়, সেগুলোর দাম অত্যন্ত চড়া এবং সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে।

হাওড় পাড়ের একাধিক প্রবীণ ও অভিজ্ঞ লোকজনের ভাষ্য, ইজারাদারদের স্বেচ্ছাচারী মনোভাব ও অধিক মুনাফার কারণে অবৈধ জাল দিয়ে মা মাছ ও পোনা মাছ অবাধে নিধনের ফলে এমনটি হচ্ছে। যদি প্রজননকালীন স্থানীয় প্রশাসন সঠিকভাবে নজরদারি করে তাহলে দেশীয় মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি হবে বলেও জানান তারা।

বানিয়াচং (হবিগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার হাওড়ের দেশীয় মাছ এলাকার চাহিদা মিটিয়ে পাইকাররা রপ্তানি করতেন দেশের বিভিন্ন স্থানে। কালের পরিবর্তনে বর্তমানে বাজারে মিলছে না দেশীয় মাছ। বিভিন্ন পুকুরে চাষ করা হাইব্রিড মাছ আসছে বাজারে। তাও আবার তিন থেকে সাড়ে তিনশ' টাকা কেজি। দেশীয় মাছ কিছুটা বাজারে দেখা গেলেও দাম অনেক চড়া। প্রতি কেজির দাম হাজারের ওপরে। বানিয়াচংয়ের নদীগুলো মেঘনার সংযোগ স্থলে বাঁধ ও কুশিয়ারা নদীর পানি বানিয়াচং ও আজমিরীগঞ্জে না আসায় এবার বৃষ্টি কম হয়েছে।

হাওড়াঞ্চল ঘুরে দেখা গেছে, অতীতে যেসব আমন জমিতে ১০ থেকে ১২ ফুট পানি হতো তা এখন শুকনো। হাওড় এলাকায় পানি না আসার কারণ হিসেবে কুশিয়ার নদীর কৈয়ার ডালা বাঁধকে দায়ী করেছেন কৃষকরা। কৈয়ার ডালায় স্স্নুইসগেট করার কথা থাকলেও তা না করে পাকা বাঁধ দেওয়া হয়েছে। বানিয়াচংয়ের নদীগুলো মেঘনার মোহনায় পলি পড়ে ভরাট ও অপরিকল্পিত বাঁধ দেওয়ার কারণে মাছসহ জীববৈচিত্র্য বিলুপ্তির মুখে। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, পুকুরে চাষ করা ছোট শিং মাছ ৫০০ টাকা কেজি, পাঙ্গাশ ১৯০ টাকা, তেলাপিয়া ২০০ টাকা, অন্যান্য মাছ ৪০০ টাকা কেজি। দেশীয় প্রজাতির হাওড়ের মাছ টাকি ৪০০ টাকা। কিছু টেংরা মাছ বাজারে দেখা গেছে। ভাগ ভাগ করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। প্রতি ভাগ ৬০০ টাকা। টেংরা মাছের কেজি জানতে চাইলে বিক্রেতা ১ হাজার টাকার কমে বিক্রি করবেন না বলে জানান। দুই বছর আগেও টেংরা মাছ বাজারে ১৫০ থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে বলে ওই মৎস্যজীবী জানান। তিনি জানান, তখন হাওড়ে প্রচুর মাছ ছিল। এখন হাওড়ে মাছের আকাল।

শ্রমজীবী আবিদ মিয়া জানান, 'সারা দিনে ৪০০ টাকা পেয়েছি। পরিবারের সদস্য ৬ জন। তাই ১৯০ টাকায় ১ কেজি পাঙ্গাশ ও ৫০ টাকায় এক কেজি আলু কিনলাম। বাকি টাকায় চাল কিনব।'

অভিজ্ঞ মহলের অভিমত-নদী, বিল খননসহ কৈয়ার ডালায় স্স্নুইসগেট নির্মাণ ও মেঘনার মোহনায় বাঁধসহ পলি খনন করে সরানো হলে আবার ফিরে আসবে হাওড়ের হারিয়ে যাওয়া যৌবন। বানিয়াচং উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা বোরহান উদ্দিন জানান, হাওড় মানেই পানি, আর এবার সেই হাওড়ে পানি নেই। সে কারণে মাছের বংশবৃদ্ধি না হওয়ায় সংকট দেখা দিয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে