শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
যশোর জেলা আওয়ামী লীগ

নির্বাচনকে সামনে রেখে ঘর গোছানো শুরু

ব্রিটিশ ভারতের প্রথম জেলা এবং দেশের প্রথম শত্রম্নমুক্ত জেলা যশোর। ইতিহাস, ঐতিহ্যের পাশাপাশি রাজনীতিতেও সমৃদ্ধ এই জেলা। আওয়ামী লীগ, বিএনপি যে দলই সরকার গঠন করুক; এই জেলার ৬টি আসনই তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেক সরকারের মন্ত্রিপরিষদে যশোরের প্রতিনিধিত্ব থাকে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে যশোরের রাজনীতিতেও নানা মেরুকরণ হচ্ছে। আওয়ামী লীগের টার্গেট গ্রম্নপিং-লবিং সরিয়ে ঘর গোছানো; আর 'হামলা-মামলা' সঙ্গে নিয়ে বিএনপির সংগ্রাম ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য। যশোরের আওয়ামী লীগ-বিএনপি নিয়ে রাজনৈতিক প্রতিবেদন তৈরি করেছেন যশোরের স্টাফ রিপোর্টার মিলন রহমান
নতুনধারা
  ২০ মে ২০২২, ০০:০০

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ঘর গোছানো শুরু করেছে যশোর জেলা আওয়ামী লীগ। যদিও দলের মধ্যে গ্রম্নপিং-লবিং রয়েছে। ক্ষোভ-হতাশা আছে কমিটি নিয়েও। তারপরও জেলার শীর্ষ নেতারা বলছেন, নৌকার পেছনে ঐক্যবদ্ধ থেকেই তারা আগামী নির্বাচনের বৈতরণী পার হতে চান।

যশোর জেলা আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সর্বশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলন থেকে শহিদুল ইসলাম মিলনকে সভাপতি ও শাহীন চাকলাদারকে সাধারণ সম্পাদক করে ২২ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছিল। এর প্রায় দু'বছর পর ২০২১ সালের ৩০ জুলাই আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ১৯ জন উপদেষ্টাসহ ৯৪ সদস্যের যশোর জেলা আওয়ামী লীগ কমিটি অনুমোদন দেন। কমিটিতে ১৯ সদস্যের উপদেষ্টা পরিষদ ও ৭৫ সদস্যের কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়। নির্বাহী কমিটির মধ্যে সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলন, তার ছেলে, ভায়রা ভাই ও শ্যালক জায়গা করে নেয়ায় নানান আলোচনারও সৃষ্টি হয়।

সূত্র অনুযায়ী, গত কমিটির কৃষি বিষয়ক সম্পাদক মোশাররফ হোসেন, মহিলা বিষয়ক সম্পাদক পৌর কাউন্সিলর রোকেয়া পারভীন ডলি, বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক রেজাউল ইসলাম, মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক সম্পাদক কাজী রফিক ও দপ্তর সম্পাদক মাহমুদ হাসান বিপু নতুন কমিটিতে স্থান পাননি।

অন্যদিকে, সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলনের ছেলে সামির ইসলাম পিয়াস সদস্য হয়েছেন। ভায়রা ভাই শেখ আতিকুর বাবু শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক এবং শ্যালক হুমায়ুন কবির কবু হয়েছেন সহসভাপতি। এরমধ্যে শ্যালক আগের কমিটিতে থাকলেও নতুন যুক্ত হয়েছেন ছেলে ও ভায়রা ভাই।

অভিযোগ রয়েছে, যশোরের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত নন এমন অনেককেই তদবিরের মাধ্যমে কমিটিতে স্থান দেওয়া হয়েছে। আবার অনেক ত্যাগী নেতা কমিটিতে পদবঞ্চিত হন। ফলে দলীয় কর্মসূচিতে জেলা আওয়ামী লীগের পদধারী বেশিরভাগ নেতা অনুপস্থিত থাকেন। সর্বশেষ ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবসের (১৭ এপ্রিল) আলোচনা সভায় উপস্থিত ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের মাত্র ৮ জন নেতা। সিংহভাগ নেতার অনুপস্থিতিতে ক্ষুব্ধ সভাপতি-সম্পাদক বলেছিলেন, কমিটি বিলুপ্ত করে সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন কমিটি দিতে।

মুজিবনগর দিবসের অনুষ্ঠানে ক্ষুব্ধ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এমপি শাহীন চাকলাদার বলেছিলেন, 'আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ একটা অনুষ্ঠানে জেলার সিনিয়র কোনো নেতাই উপস্থিত হননি। এই সভা থেকে আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে চাইব, এই জেলা কমিটি ভেঙ্গে দিয়ে নতুন করে আবার কাউন্সিলর দিয়ে, অন্ততপক্ষে যারা দলের দুর্দিনে সবসময় দলের সঙ্গে থাকেন তাদের দিয়েই কমিটি ঘোষণা করতে। এখন হালুয়া রুটির ভাগাভাগির সময়। কেউ এখন বসে স্কুল দখল করবে। কেউ নদীর বালির মহল দখল করবে। এই সমস্ত নেতা দিয়ে আওয়ামী লীগ চলছে। এটা দুঃজনক ব্যাপার। আজ ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস। আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ একটা দিনে যশোর জেলা আওয়ামী লীগের তেমন কোনো নেতাই আসেননি।'

অনুষ্ঠানে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলন বলেছিলেন, জেলা কমিটির এত বহর, অথচ অনুষ্ঠানে আজ জেলার উলেস্নখযোগ্য কোনো নেতা উপস্থিত নেই। আছে গুটিকয়েক ছাত্রলীগ ও শহরের নেতাকর্মীরা। জেলা আওয়ামী লীগের যে সব সিনিয়র নেতা আজ অনুষ্ঠানে আসেননি তাদের নাম উলেস্নখ করে তিনি আরও বলেন, 'আপনারা জেলা আওয়ামী লীগের পদপদবি নেওয়ার জন্য তদবির করবেন, অথচ পদ পাওয়ার পরে দলের কর্মসূচিতে উপস্থিত হবে না এটা দুঃখজনক। বিশৃঙ্খলাকারীদের দলে জায়গা হবে না।'

এদিকে, এক বছর ৮ মাস পর জেলা আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি হলেও এখনো পূর্ণাঙ্গ কমিটি পায়নি যশোর সদর ও পৌর আওয়ামী লীগ। অথচ এই দুটি ইউনিটেরই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে আড়াই বছর আগে। ২০১৯ সালের ১৬ নভেম্বর যশোর সদর উপজেলা ও পৌর আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে যশোর সদর উপজেলা শাখা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন মোহিত কুমার নাথ ও সাধারণ সম্পাদক হন ইউপি চেয়ারম্যান শাহারুল ইসলাম। আরও শহর শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান আসাদ ও সাধারণ সম্পাদক হন এসএম মাহমুদ হাসান বিপু।

কিন্তু এরপর আড়াই বছর পার হলেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি পায়নি এ দুটি ইউনিট। ফলে এসব কমিটিতে নেতৃত্বপ্রত্যাশীদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে যশোর শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এসএম মাহমুদ হাসান বিপু বলেন, সম্মেলনের পরপরই তারা করোনা মহামারির মধ্যে পড়েন। এতে প্রায় দু'বছর পার হয়েছে। তবে এর মধ্যে তারা তৃণমূলকে শক্তিশালী করতে নির্বাচনী কেন্দ্র অনুযায়ী সেন্টার কমিটি গঠন করেছেন। আর পৌর আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত পূর্ণাঙ্গ কমিটির জেলা কমিটিতে জমা দেওয়া হয়েছে। যশোর সদর উপজেলা কমিটির সভাপতি মোহিত কুমার নাথ বলেন, তারাও পূর্ণাঙ্গ কমিটি জমা দিয়েছেন। এখন অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।

এদিকে, যশোরের ৬টি সংসদীয় আসনের অধিকাংশ এলাকায় আওয়ামী লীগের মধ্যে গ্রম্নপিং রয়েছে। তৃণমূলের নেতাকর্মীরা বলছেন, এই গ্রম্নপিংয়ের বিভাজনকে প্রশমিত করে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ায় একটি বড় চ্যালেঞ্জ। যদিও জেলা শীর্ষ নেতৃবৃন্দ এটিকে গ্রম্নপিং নয়; বরং নেতৃত্বের ইতিবাচক প্রতিদ্বন্দ্বিতা হিসেবে দেখতে আগ্রহী। তাদের মতে, নৌকার প্রার্থী চূড়ান্ত হলে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে নৌকার পেছনে থাকবেন।

যশোর জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার এমপি বলেন, আগামী সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগ এখন দলকে সুসংগঠিত করছে। ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, উপজেলা পর্যায়ে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি ভেঙে নতুন করে কমিটি করা হচ্ছে। তৃণমূলকে শক্তিশালী করে সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ডের বার্তা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি জামায়াত-বিএনপির অপপ্রচার ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জনগণকে সজাগ ও সচেতন করা হচ্ছে।

শাহীন চাকলাদার এমপি আরও বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ড বিশেষ করে মেগাপ্রকল্পগুলো সম্পর্কে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের জানানো হচ্ছে এবং তাদের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে উন্নয়ন অগ্রগতির বার্তা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি বিগত বিএনপির আমলে বিদু্যতহীনতা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, সারের জন্য গুলি করে হত্যা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতির চিত্রও সাধারণ মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যাতে তারা অপপ্রচার ষড়যন্ত্রে বিভ্রান্ত না হন এবং সচেতনভাবে নৌকায় ভোট দেন।

গ্রম্নপিং প্রসঙ্গে শাহীন চাকলাদার এমপি বলেন, জাতীয় নির্বাচন নিয়ে কোনো কোন্দল-গ্রম্নপিং করার সুযোগ নেই। দলীয় সভানেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চুলচেরা বিশ্লেষণ করে নৌকা প্রতীকের জন্য প্রার্থী মনোনীত করেন। ফলে নেত্রীর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নৌকাকে বিজয়ী করে দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে পুনরায় প্রধানমন্ত্রীর আসনে আসীন করতে হবে।

এ প্রসঙ্গে যশোর জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলন বলেন, দলে সাংগঠনিক কোনো কোন্দল নেই। আর জাতীয় নির্বাচনে গ্রম্নপিংয়ের সুযোগ নেই। কারণ নৌকার বাইরে নির্বাচনে যাওয়ারও সুযোগ নেই। কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হলে বা বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে অবস্থান নিলে দল অত্যন্ত কঠোর। দলের নেতাকর্মীরা এটি ভালো করেই জানেন। ফলে আগামী সংসদ নির্বাচনে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে নৌকার সঙ্গেই থাকতে হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে