সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১
টাঙ্গাইল-৪

বড় দুই দলের কাছেই ফ্যাক্টর ভিআইপি প্রার্থী লতিফ সিদ্দিকী

জোবায়েদ মলিস্নক বুলবুল ও রাইসুল ইসলাম লিটন
  ১৪ মার্চ ২০২৩, ০০:০০

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) আসনে আওয়ামী লীগ-বিএনপির একাধিক সম্ভাব্য প্রার্থী আগাম গণসংযোগ করছেন। ১৩টি ইউনিয়ন ও দুটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত জাতীয় সংসদের ১৩৩ টাঙ্গাইল-৪ আসনে সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলেরই গলার কাঁটা এমনটি মনে করছেন নির্বাচন বোদ্ধারা।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে সব দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা বেশ আগে থেকে গণসংযোগ শুরু করেছেন। বড় দুই দলের মনোনয়ন প্রত্যাশীরা তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে কুশল বিনিময়, নির্বাচনী এলাকায় পোস্টার ও লিফলেট সেঁটে জনগণের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন। তৃণমূল নেতাদের সমর্থন ও কেন্দ্রের সবুজ সংকেত পেতে লবিংও চালাচ্ছেন প্রার্থীরা।

টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) আসনটি বরাবরই ভিআইপি আসন হিসেবে চিহ্নিত। এ আসনের চির প্রতিদ্বন্দ্বী মহান স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠক ও সাবেক মন্ত্রী শাজাহান সিরাজ মৃতু্যবরণ করেছেন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে টাঙ্গাইলের সংগঠক আবদুল লতিফ সিদ্দিকী রাজনীতির মাঠ থেকে ছিটকে পড়েছেন। এদের মধ্যে শাজাহান সিরাজ অসুস্থতাজনিত কারণে ইন্তেকাল করেন এবং আবদুল লতিফ সিদ্দিকী হজ ও তাবলিগ জামাত নিয়ে আপত্তিকর বক্তব্যের কারণে মন্ত্রিত্ব হারান, দল থেকে বহিষ্কৃত হন এবং সংসদ সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন।

শাজাহান সিরাজ ও লতিফ সিদ্দিকীর মধ্যে চির প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকলেও তাদের মধ্যে মঞ্চের বাইরে অত্যন্ত সুনিবিড় সুসম্পর্ক ছিল। অসুস্থতার সময় শাজাহান সিরাজের খোঁজখবর ও চিকিৎসার দেখভাল করেছেন লতিফ সিদ্দিকী। বস্তুত দলীয় রাজনীতি থেকে বিচু্যত হলেও আবদুল লতিফ সিদ্দিকী মনে করেন তিনি সাচ্চা আওয়ামী লীগার, আওয়ামী লীগ থেকে কেউ তাকে সরাতে পারবে না। তিনি এখনো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর আস্থাশীল। নানা কথা ও আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তিনি 'দেবী' বলে সম্বোধন করে থাকেন।

টাঙ্গাইলের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণের কারণে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন এমন আভাস তার কাছের

লোকজনের। টাঙ্গাইল-৪ আসনে অত্যন্ত জনপ্রিয় প্রার্থী লতিফ সিদ্দিকী কোনো কারণে নির্বাচনে অংশ না নিলে তার সহধর্মিণী সাবেক এমপি বেগম লায়লা সিদ্দিকী নির্বাচন করবেন- এমন আলোচনা স্থানীয় পর্যায়ে। সংসদ থেকে পদত্যাগ করলেও নিয়মিত সস্ত্রীক এলাকায় যাতায়াত করছেন লতিফ সিদ্দিকী। কাছের লোকদের নিয়ে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছেন। তিনি নির্বাচনী মাঠে থাকলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলের জন্যই বড় বাধা বলে মনে করেন উভয় দলের নেতাকর্মীরা। এ আসনে সাবেক মন্ত্রী শাজাহান সিরাজের মেয়ে ব্যারিস্টার সরোয়াত সিরাজ শুক্লা (শুক্লা সিরাজ) প্রয়াত বাবার অনুসারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। নানা সামাজিক কাজে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দিচ্ছেন। ঢাকার গুলশান সোসাইটির সাবেক সেক্রেটারি শুক্লা সিরাজ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবেন এমনটাই মনে করছেন তার কাছের লোকজন।

স্থানীয় রাজনৈতিক বোদ্ধারা মনে করছেন টাঙ্গাইল-৪ আসনটি ভিআইপি হলেও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মহাজোটের আসন হিসেবে আওয়ামী লীগ ছেড়ে দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে মহাজোটের অন্যতম শরিক দল জাতীয় পার্টির (এরশাদ) প্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার লিয়াকত আলী এ আসনে মনোনয়ন পেতে পারেন। আসনটি কৃষক শ্রমিক জনতা লীগও দাবি করে আসছে। সবশেষ মহাজোটের কাছ থেকে তারা এ আসনটি পেলে কাকে প্রার্থী করবেন তা জানা যায়নি। তবে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের স্থানীয় সভা-সমাবেশে সা'দত কলেজের সাবেক ভিপি শামীম আল মনসুর আজাদ সিদ্দিকী কৌশলে প্রার্থিতা জানান দিচ্ছেন।

জেলা নির্বাচন অফিস সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭৩ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ৩ বার, বিএনপি প্রার্থী ৩ বার, জাতীয় পার্টির প্রার্থী ১ বার, জাসদ (সিরাজ) প্রার্থী ১ বার এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী ১ বার জয়লাভ করেছেন এ আসন থেকে। মহান মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগার টাঙ্গাইলের কালিহাতী থেকে মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ আবদুল লতিফ সিদ্দিকী ১৯৭০ সালে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য, এরপর ১৯৭৩, ১৯৯৬, ২০০৮ ও ২০১৪ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এ আসনে যিনি এমপি নির্বাচিত হয়েছেন তার দলই সরকার গঠন করেছে- এজন্য এ আসনটিকে 'শুভ আসন' হিসেবে বিবেচনা করেন কেউ কেউ।

সরেজমিন দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০০৮ সালে শাহজাহান সিরাজ জেলহাজতে থাকায় এ আসনে বিএনপির মনোনয়ন দেওয়া হয় বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্য নির্বাহী কমিটির সদস্য শিল্পপতি লুৎফর রহমান মতিনকে। তিনি আওয়ামী লীগের আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর কাছে পরাজিত হন। লতিফ সিদ্দিকী এমপি হওয়ার পর সরকারের মন্ত্রী হিসেবে এলাকার বেশ উন্নয়ন করেন। সর্বশেষ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে পুনরায় আবদুল লতিফ সিদ্দিকী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হন। এ আসনে আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর জনপ্রিয়তা এখনো ঈর্ষণীয়।

আসনটিতে শাসকদল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির আন্তঃকোন্দল সীমাহীন। আওয়ামী লীগ, সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠনগুলো দৃঢ় সাংগঠনিক দক্ষতায় নিয়ন্ত্রণ করতেন আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। তার অনুপস্থিতিতে দলের সর্বেসর্বা এখন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোজহারুল ইসলাম তালুকদার। এদিকে, আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর পদত্যাগের পর উপ-নির্বাচনে এমপি হন মোহাম্মদ হাছান ইমাম খান সোহেল হাজারি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেলে তিনি নির্বাচিত হন। স্থানীয় সংসদ সদস্য মোহাম্মদ হাছান ইমাম খান সোহেল হাজারির সঙ্গে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোজহারুল ইসলামের সুসম্পর্ক থাকলেও ভেতরে ভেতরে দূরত্ব যোজন যোজন। উভয়ের মধ্যকার অভ্যন্তরীণ সম্পর্ক সাপেনেউলে। কেউ কাউকে সহ্য করেন না। সভা-সমাবেশ ও দলীয় কর্মসূচি একত্রে করলেও অভ্যন্তরীণ দূরত্বটা স্পষ্ট। মোজহারুল ইসলাম তালুকদারের অভিযোগ, এমপি সোহেল হাজারি বিএনপি-জামায়াতের লোক নিয়ে চলাফেরা করেন, দলের ত্যাগী নেতাকর্মীদের গুরুত্ব দেন না। আর এমপি সোহেল হাজারির বক্তব্য হচ্ছে, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি তাকে দলীয় কাজে খুব কমই ডাকেন, যথাযথ মূল্যায়নও করেন না। সাংগঠনিক কর্মকান্ডে তিনি নিজেই উপস্থিত হন।

বর্তমান সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের মোহাম্মদ হাছান ইমাম খান সোহেল হাজারি আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হবেন। দলীয় মনোনয়নও তিনিই পাবেন এমন বিশ্বাস তার কর্মী-সমর্থকদের। সোহেল হাজারি প্রতি সপ্তাহে অন্তত ৪ থেকে ৫ দিন ভোর থেকে রাত পর্যন্ত এলাকার মানুষের খোঁজখবর নেন। সময়-অসময়ে দলীয় নেতাকর্মীদের বাড়িতে গিয়ে হাজির হন, কুশল বিনিময় করেন। তবে এক আওয়ামী লীগ নেতা তার শিক্ষা সনদ জালিয়াতির অভিযোগ এনে উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন করায় এবং উচ্চ আদালত তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়ায় স্থানীয় রাজনীতিতে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। তবে সোহেল হাজারি মনে করেন, বিষয়টি আদালতের তিনি আদালতেই জবাব দেবেন। তিনি এমপি নির্বাচিত হয়ে কালিহাতী উপজেলা সদর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। মহান স্বাধীনতার পর তিনিই কালিহাতীর সবচেয়ে বেশি উন্নয়ন করেছেন বলে দাবি করেন। দল তার কাজের মূল্যায়ন করবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন।

এ আসনে দলীয় মনোনয়ন পেতে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোজহারুল ইসলাম তালুকদার ঠান্ডু দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করছেন। সাংগঠনিক দক্ষতা ও আওয়ামী লীগের প্রতি তার বিশ্বস্ততা প্রশ্নাতীত। কালিহাতী উপজেলার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যে কোনো সদস্য তো বটেই আওয়ামী পরিবারের যে কোনো ছোট্ট সদস্যাটিও তার পরিচিত। প্রত্যেক আওয়ামী লীগারের বিপদে-আপদে তিনি পাশে দাঁড়ান। সাংগঠনিক তৎপরতার পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন সামাজি অনুষ্ঠানাদিতেও নিজের প্রার্থিতা জানান দিচ্ছেন। এদিকে এফবিসিসিআইর পরিচালক আবু নাসের এ আসনে দলীয় মনোনয়নের প্রত্যাশায় দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের ব্যানারে তিনি জনহিতকর কাজে অংশ নিয়ে থাকেন। দীর্ঘদিনের সাংগঠনিক তৎপরতায় উপজেলার বিভিন্ন স্থানে সমাজের শিক্ষিত শ্রেণির একটি অংশ তার প্রচারণা চালাচ্ছে।

টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) আসনে বিএনপির আন্তঃকোন্দলও চরমে। মহান স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠক প্রয়াত শাজাহান সিরাজের অনুসারীরা কার্যত শুক্লা সিরাজের পক্ষে কাজ করছেন। বিএনপি নেতা লুৎফর রহমান মতিন ও বেনজীর আহম্মেদ টিটোরও রয়েছে নিজ নিজ গ্রম্নপ। ২০০৮ সালে বিএনপির মনোনয়ন পেয়ে কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য শিল্পপতি লুৎফর রহমান মতিন পরাজিত হলেও ভোট পান ৮৬ হাজার ৯১২টি। কিন্তু নির্বাচনের পরই তিনি দলীয় কার্যক্রমে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। সরকারবিরোধী কোনো কর্মকান্ডে দলীয় নেতাকর্মীরা তাকে পাশে পাননি। আন্দোলন-সংগ্রামে মামলা-হামলার শিকার নেতাকর্মীরা এলেঙ্গা পৌরসভার সাবেক মেয়র মো. শাফী খানের দিকে ঝুঁকে পড়েন। ফলে জেলা বিএনপি নেতা মো. শাফী খান তৃণমূলের নেতাকর্মীদের প্রিয়পাত্র। এলেঙ্গা পৌরসভার মেয়র পদে এবার তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন। তাছাড়া আগে থেকেই দলীয় মনোনয়ন নিয়ে কালিহাতী উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি শিল্পপতি লুৎফর রহমান মতিনের সঙ্গে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠক সাবেক মন্ত্রী শাজাহান সিরাজের সহধর্মিণী বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য বেগম রাবেয়া সিরাজের দ্বন্দ্ব রয়েছে। আগামী নির্বাচনে বেগম রাবেয়া সিরাজের মেয়ে শুক্লা সিরাজ দলীয় মনোনয়ন চাইতে পারেন। উপজেলা বিএনপির একটি অংশ মনে করে, শিল্পপতি লুৎফর রহমান মতিন ব্যবসায়ী হলেও কালিহাতী বিএনপির রাজনীতিতে তার প্রয়োজন রয়েছে। উপজেলা বিএনপির এই কোন্দলের মধ্যে দলের হাল ধরেন সাবেক ছাত্রদল নেতা বেনজীর আহমেদ টিটো। তিনি এখন বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক (ঢাকা বিভাগ)।

এ আসনে জেলা বিএনপির এক নম্বর সদস্য বেনজীর আহমেদ টিটো একজন শক্তিশালী মনোনয়ন প্রত্যাশী। এছাড়া মালয়েশিয়া বিএনপির সভাপতি প্রকৌশলী বাদলুর রহমান খান বাদল ও কালিহাতী উপজেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক শুকুর মামুদ দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী। বাদলুর রহমান খান বাদল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও ব্যবসায়িক পার্টনার।

টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) সংসদীয় আসনের ১৩ ইউনিয়ন ও দুই পৌরসভায় মোট ভোটার তিন লাখ ১২ হাজার ৪১৫ জন। এর মধ্যে নারী ভোটার এক লাখ ৫৬ হাজার ৮৫৯ এবং পুরুষ ভোটার এক লাখ ৫৫ হাজার ৫৫৬ জন।

আগামীকাল : টাঙ্গাইল-৫ আসনের বিস্তারিত

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে