সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

সহজ শর্তে ঋণ অব্যাহত রাখুন

উন্নয়ন অংশীদারদের প্রতি প্রধানমন্ত্রী
যাযাদি ডেস্ক
  ১৫ মার্চ ২০২৩, ০০:০০
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে মঙ্গলবার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে এডিবির প্রেসিডেন্ট মাসাতসুগু আসাকাওয়ার নেতৃত্বে প্রতিনিধি দল সাক্ষাৎ করে। এ সময় সংস্থাটির প্রেসিডেন্টকে নৌকা উপহার দেন প্রধানমন্ত্রী -ফোকাস বাংলা

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে যে অর্থনৈতিক মন্দা তৈরি হয়েছে, তা কাটিয়ে বিশ্ব অর্থনীতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত সহজ শর্তে ঋণ অব্যাহত রাখতে উন্নয়ন সংস্থা ও উন্নত দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

তিনি বলেছেন, 'বৈশ্বিক অর্থনীতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে না আসা পর্যন্ত সহজ শর্তে অর্থায়ন অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং উন্নত দেশগুলোকে এ বিষয়ে বিশেষ নজর দিতে হবে, আমরা তাদের নজর চাই।'

বাংলাদেশ ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অংশীদারিত্বের ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন উপলক্ষে মঙ্গলবার এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশ সরকার এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক যৌথভাবে হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

এডিবির প্রেসিডেন্ট মাসাতসুগু আসাকাওয়া, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব শরিফা খানও অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন। সমাপনী বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশে এডিবির কান্ট্রি ডিরেক্টর এডিমন গিনটিং।

বাংলাদেশ-এডিবি সম্পর্ক কিভাবে বিকশিত হয়েছে এবং ৫০ বছরে ও সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ কিভাবে এগিয়ে যাচ্ছে. তার ওপর একটি ভিডিও ডকুমেন্টারি প্রদর্শিত হয় অনুষ্ঠানে।

আমরা কারও কাছে করুণা বা দয়া চাই না জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'আমরা ন্যায্য অধিকার চাই। বৈশ্বিক সম্প্রদায়ের অংশীদার হিসেবে আমরা আমাদের ন্যায্য হিস্যাই দাবি করছি। এই সংকটময় সন্ধিক্ষণে, আমরা হতাশার সঙ্গে লক্ষ্য করছি অনেক উন্নয়ন অংশীদার সুদের হার বাড়িয়ে দিচ্ছে যা বেশিরভাগ প্রকল্পের জন্য উন্নয়ন-অর্থায়নকে অর্থনৈতিকভাবে অকার্যকর করে তুলছে। তাই একাধিক অর্থনৈতিক ধাক্কার প্রভাব মোকাবিলায় আমাদের মধ্যে সমন্বয় গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি।'

শেখ হাসিনা বলেন, 'বৈশ্বিক ব্যবসায়িক অংশীদাররা ''অপ্রয়োজনীয়'' বাণিজ্য বিধিনিষেধ আরোপ করছে। এটা সার্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে আমি দক্ষতা উন্নয়ন, স্বাস্থ্য, আইসিটি-ভিত্তিক উদ্যোক্তা, মানসম্পন্ন অবকাঠামো এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর কৌশলগত গুরুত্বারোপসহ অর্থায়নের নমনীয় পদ্ধতি এবং উদ্ভাবনী অর্থায়নের জন্য এডিবির প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি।'

টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে বেসরকারি খাতের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো গুরুত্বপূর্ণ উলেস্নখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটি বিনিয়োগ-বান্ধব ব্যবসায়িক পরিবেশ তৈরিতে অবদান রাখবে বলে আমার বিশ্বাস।

তিনি বলেন, 'চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টা নিষেধাজ্ঞার কারণে বিশ্ব যে একাধিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। আমরা এই ভূ-রাজনৈতিক সংকটের শিকার হলেও এজন্য আমরা মোটেও দায়ী নই। বরং এটি কষ্টার্জিত অর্জনগুলোকেই নস্যাৎ করছে এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে আমাদের ঠেলে দিচ্ছে। আমরা সত্যিই এই সংকটের কোনো তাৎক্ষণিক সমাধান দেখতে পাচ্ছি না। শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বব্যাপী এই সমস্যা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষ আরও কষ্ট পাচ্ছে।'

'বেশিরভাগ দেশই খাদ্য, জ্বালানি এবং আর্থিকভাবে মারাত্মক সংকটের সম্মুখীন হচ্ছে' উলেস্নখ করে শেখ হাসিনা বলেন, এর ফলে মুদ্রার অবমূল্যায়ন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ধস এবং মুদ্রাস্ফীতি আরও দ্রম্নত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সবচেয়ে গুরুতর উদ্বেগের বিষয় হলো- এসব বিষয় বিশ্ব সম্প্রদায়ের দরিদ্রতম অংশকে অন্যায্যভাবে প্রভাবিত করছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'কোভিড-১৯ মহামারি চলাকালে স্বাস্থ্য সংকট মোকাবিলায় এডিবি ২ দশমিক ২৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সহায়তা দিয়েছে। আমি এই সহায়তা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করছি। সম্প্রতি এডিবি বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে প্রলয়ঙ্করী বন্যার ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় ২৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের জরুরি সহায়তা নিয়ে এগিয়ে এসেছে। এ ছাড়া এডিবি জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব প্রশমন ও অভিযোজনে স্বল্পসুদে অর্থায়ন করছে। 'আমরা অত্যন্ত সন্তোষের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, দুঃসময়ে এডিবি উদ্ভাবনী অর্থায়ন এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা নিয়ে সব সময় বাংলাদেশের পাশে থেকেছে।'

শেখ হাসিনা বলেন, 'এডিবির সঙ্গে বাংলাদেশের ৫০ বছরের সম্পর্ক ১৯৭৩ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বেই প্রথম এডিবির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। গত ৫০ বছরে আমাদের আর্থসামাজিক এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রায় সব খাতে তাদের সহায়তা রয়েছে। গত এক দশকে বাংলাদেশে এডিবির সহায়তা প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর থেকে এডিবির সহযোগিতার হার বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে এডিবির ক্রমবর্ধমান অবদান দাঁড়িয়েছে ২৮ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। এডিবির পোর্টফোলিওতে বাংলাদেশ এখন তৃতীয় বৃহত্তম গ্রাহক।'

তিনি বলেন, 'আমরা বর্তমানে এডিবির আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তায় ৫৪টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছি। দক্ষিণ এশিয়া উপ-আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সহযোগিতার (সাসেক) অধীন এডিবি-অর্থায়নকৃত আঞ্চলিক সহযোগিতা এবং সংযোগ প্রকল্পগুলো অশুল্ক বাধা হ্রাস করে পণ্য ও পরিষেবায় আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্যের প্রসারে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।'

প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'গত দেড় দশকে বাংলাদেশ উন্নয়নের অভাবনীয় যাত্রার সাক্ষী হয়েছে। আমরা এই সময় ৬ দশমিক ৫ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছি। দারিদ্র্য হ্রাস, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, মাতৃ ও শিশুমৃতু্য হার হ্রাস, সাক্ষরতার হার ও গড় আয়ু বৃদ্ধি, খাদ্য নিরাপত্তা এবং লিঙ্গ সমতা অর্জনের ক্ষেত্রেও আমরা অসামান্য অগ্রগতি অর্জন করেছি। আমরা কোভিড-১৯ মহামারিকেও সফলভাবে মোকাবিলা করেছি। আমাদের এই উন্নয়ন প্রচেষ্টা বিশ্ব সম্প্রদায় দ্বারা স্বীকৃত। আগামী বছরের মধ্যে আমরা দেড় ট্রিলিয়ন অর্থনীতির মাইলফলক স্পর্শ করতে যাচ্ছি। বর্তমান জিডিপির আকারে বাংলাদেশ বিশ্বের ৩৫তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। ধারাবাহিকভাবে এই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সালে ২৮ এবং ২০৩৬ সালের মধ্যে ২৪তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশে পরিণত হবো।'

প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'বাংলাদেশ ইতোমধ্যে বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়নে সক্ষমতা প্রদর্শন করতে পেরেছে। উলেস্নখযোগ্য প্রকল্পের মধ্যে কয়েকটি হচ্ছে- পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু টানেল এবং এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণ ছিল আমাদের জন্য গৌরব, মর্যাদা ও যোগ্যতার প্রতীক- যা বাংলাদেশ পারে।'

তিনি বলেন, 'জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ৫ বছরের প্রস্তুতিমূলক সময়সহ এলডিসি থেকে আমাদের উত্তরণ অনুমোদন করেছে। আমরা এখন একটি মসৃণ এবং টেকসই উত্তরণ নিশ্চিত করতে কাজ করছি। আমরা চট করে কোথাও লাফ দিয়ে পড়িনি। প্রতিটি ক্ষেত্রেই ধাপে ধাপে আমাদের উত্তরণ ঘটাচ্ছি। আমাদের আশু লক্ষ্য হলো ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা অর্জন করা। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত, সমৃদ্ধ, জ্ঞানভিত্তিক এবং স্মার্ট দেশ হিসেবেই বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে আমাদের সরকার কাজ করে যাচ্ছে।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে