সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১
টাঙ্গাইল-৬

ধরে রাখতে সচেষ্ট আ'লীগ বিএনপি চায় পুনরুদ্ধার

জোবায়েদ মলিস্নক বুলবুল/আবু বকর সিদ্দিকী/মাসুদ রানা
  ১৬ মার্চ ২০২৩, ০০:০০

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে টাঙ্গাইল-৬ (নাগরপুর-দেলদুয়ার) আসনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির এক ডজনের বেশি মনোনয়ন প্রত্যাশী কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছেন। সম্ভাব্য প্রার্থীদের পোস্টার, ফেস্টুন ও ব্যানারে ছেয়ে গেছে দুই উপজেলার দর্শনীয় স্থান। নাগরপুর ও দেলদুয়ার উপজেলার সার্বিক উন্নয়নে আওয়ামী লীগ এ আসনটি ধরে রাখতে সচেষ্ট আর বিএনপি পুনরুদ্ধার করতে চায়। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীরা বিভিন্ন সভা-সমাবেশে অংশ নিয়ে উন্নয়নের নানা প্রতিশ্রম্নতির বন্যা বইয়ে দিচ্ছেন। বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীরা সরকারের নানা কাজের কঠোর সমালোচনা করে তাদের দল ক্ষমতায় গেলে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে উন্নয়নের প্রতিশ্রম্নতি ব্যক্ত করছেন।

নাগরপুর ও দেলদুয়ার উপজেলা নিয়ে টাঙ্গাইল-৬ আসনটি গঠিত। অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত শুধু নাগরপুর উপজেলা নিয়েই টাঙ্গাইল-৬ আসন ছিল। দেলদুয়ার উপজেলা টাঙ্গাইল-৫ (সদর) আসনের সঙ্গে যুক্ত ছিল। ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচনী আসন পুনর্বিন্যাস করে দেলদুয়ার উপজেলাকে টাঙ্গাইল-৬ আসনের সঙ্গে যুক্ত করে।

দেলদুয়ার উপজেলাকে পুনর্বিন্যাস করে নাগরপুরের সঙ্গে সংযুক্ত করায় দীর্ঘদিন পর আওয়ামী লীগ প্রার্থীর জয়লাভের সম্ভাবনা দেখা দিলেও দলীয় অন্তঃকোন্দলের কারণে আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে পরাজয় বরণ করতে হয়। এ আসনে ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকিটে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হন খন্দকার আব্দুল বাতেন। ১৯৭৩ সালের পর এ আসনে নৌকার প্রার্থীরা বারবার পরাজিত হয়েছেন। ২০০৮ সাল পর্যন্ত প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনেই বিএনপি ও জাতীয় পার্টির প্রার্থী এমপি হয়েছেন। বিগত নির্বাচনগুলোয় বিএনপি প্রার্থী পাঁচবার, আওয়ামী লীগ প্রার্থী তিনবার, জাতীয় পার্টির প্রার্থী দুইবার ও স্বতন্ত্রপ্রার্থী একবার নির্বাচিত হন।

মহান স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ব্যারিস্টার শওকত আলী খান জয়লাভ করেন। এরপর এ আসন থেকে জাতীয় পার্টি ও বিএনপির প্রার্থীরা বিজয়ী হন। ১৯৭৯ সালে বিএনপির প্রার্থী নূর মোহাম্মদ খান আওয়ামী লীগ প্রার্থী সেতাব আলী খানকে পরাজিত করে বিজয়ী হন। ১৯৮১ সালে সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মৃতু্যর পর দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলে নূর মোহাম্মদ খান বিএনপি ছেড়ে জাতীয় পার্টিতে যোগদান করেন। ১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টির নূর মোহাম্মদ খান আওয়ামী লীগের এআর খানকে পরাজিত করে এমপি নির্বাচিত হন। ১৯৮৮ সালে বড় কোনো রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ না নিলেও জাতীয় পার্টি এককভাবে নির্বাচন করে। ওই নির্বাচনে নূর মোহাম্মদ খান বিজয়ী হন। ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগের প্রয়াত আব্দুল মান্নানকে পরাজিত করে বিএনপির আবু তাহের জয়লাভ করেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের খন্দকার আব্দুল বাতেন বিএনপির অ্যাডভোকেট গৌতম চক্রবর্তীর কাছে পরাজিত হন। ২০০১ সালের নির্বাচনেও বিএনপি প্রার্থী অ্যাডভোকেট গৌতম চক্রবর্তীর কাছে হেরে যান তিনি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্রপ্রার্থী হিসেবে খন্দকার আব্দুল বাতেন নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেয়ে তিনি এমপি নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জেলা আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সাবেক সম্পাদক ও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক সভাপতি আহ্‌সানুল ইসলাম টিটু সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এবারও তিনি দলীয় মনোনয়ন পেতে তৎপর রয়েছেন।

দলীয় নেতাকর্মীর ধারণা, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসন না হলে আসনটি আওয়ামী লীগের হাতছাড়া হতে পারে। এদিকে সাবেক প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম দলীয় মনোনয়ন পেতে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। তিনি প্রায়ই দুই উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় সভা-সমাবেশ করছেন। নাগরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাকিরুল ইসলাম উইলিয়াম, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেডের পরিচালক ও বঙ্গবন্ধু আইনজীবী পরিষদের সদস্য ব্যারিস্টার রেজা-ই-রাকিব ওরফে মুন্না, নাগরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা তারেক শামস খান হিমু, ব্যারিস্ট্রার এম আশরাফুল ইসলাম, দেলদুয়ার উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লায়ন এম শিবলী সাদিক, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সভাপতি শেখ আবদুর রহিম ইলিয়াস ও ইনসাফ আলী ওসমানীর নাম আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে শোনা যাচ্ছে। সম্ভাব্য এসব প্রার্থীরা প্রায় সবাই এলাকার বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে সহায়তা ও জনকল্যাণমূলক কাজে শরিক হচ্ছেন।

এদিকে, হারানো আসন পুনরুদ্ধারে আগে থেকেই নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে আন্দোলন-সংগ্রামের পাশাপাশি নির্বাচনী মাঠে নেমেছে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীরা। টাঙ্গাইল-৬ আসনে অ্যাডভোকেট গৌতম চক্রবর্তী টানা দুবার বিজয়ী হন। ২০০১ সালে বিজয়ী হয়ে তিনি পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি প্রয়াত হওয়ার পর বিএনপির আরেক হেভিওয়েট প্রার্থী সাবেক মন্ত্রী নূর মোহাম্মদ খান এ আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশী। ইতোমধ্যে তিনি আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচনী এলাকায় গণসংযোগও করছেন।

এ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য আহসানুল ইসলাম টিটু নাগরপুর-দেলদুয়ারের ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। দুই উপজেলার রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন চোখে পড়ার মতো। তিনি উপজেলা প্রশাসনের নানা কর্মসূচিতে উপস্থিত হয়ে দিক নির্দেশনামূলক ভূমিকা রাখেন। দলীয় কর্মসূচিতে উপস্থিত থাকেন এবং সভা-সমাবেশে সরকারের অভূতপূর্ব উন্নয়ন কর্মকান্ড জনসমক্ষে তুলে ধরেন।

সাবেক প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম জানান, আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাওয়ার অধিকার দলের প্রতিটি সদস্যের রয়েছে। নাগরপুর- দেলদুয়ারের সাধারণ মানুষের সমস্যাগুলো সমাধানই তার ব্রত। এলাকার মানুষগুলোর পাশে একটু শক্তভাবে দাঁড়ানোর জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে মনোনয়ন চাইবেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কন্যার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তিনি জানান, তাকে প্রধানমন্ত্রী এমপি ও প্রতিমন্ত্রী করে মর্যাদা দিয়েছেন। এবারও তিনি নমিনেশন পান বা না পান তিনি তার গ্রাম ও বাবার ভিটেমাটির গন্ধমাখা মানুষের পাশে আজীবন থাকবেন। নৌকা মার্কা এ আসনে বিজয়ী হোক। নেত্রী আবার ক্ষমতায় আসুক- এটিই তার কামনা। তিনি মনে করেন, আওয়ামী লীগ মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী বৃহৎ রাজনৈতিক দল। এখানে নানা ধরনের মতামত থাকবে। এটাই গণতন্ত্রের নিদর্শন। দলীয় নেতৃত্ব যাকেই মনোনয়ন দেবে সবাই তার পক্ষে কাজ করবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন। যারা দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করে দলীয় প্রার্থীর অবস্থান দুর্বল করেন তারা দলের চেয়ে নিজেকে বেশি ভালোবাসেন- যা ঠিক নয়। বিএনপির নেতিবাচক কর্মকান্ড মানুষ ভুলে যায়নি। তাই এই আসনে বিএনপির জয়লাভের সম্ভাবনা নেই।

নাগরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাকিরুল ইসলাম উইলিয়াম জানান, জন্মগতভাবে তারা আওয়ামী পরিবার। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের আদর্শ লালনকারী পরিবার। তিনি গ্রামের সাধারণ মানুষগুলোকে সঙ্গে নিয়েই কাজ শুরু করেছেন। তিনি চেয়েছেন- একেবারে মাঠ পর্যায় থেকে দলীয় গঠনতন্ত্র মেনে নির্বাচনের মাধ্যমে তৃণমূল থেকে নেতা নির্বাচিত হতে। এই চিন্তার বিস্তার ঘটাতে এলাকার মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন করতে তিনি দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী।

টাঙ্গাইল-৬ (নাগরপুর-দেলদুয়ার) আসনে ভিআইপি প্রার্থী বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী সাবেক মন্ত্রী নূর মোহাম্মদ খান। তিনি জানান, জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য তারা মানসিকভাবে সবাই প্রস্তুত। তারা মনে করেন, একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমেই দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিভিন্ন সময় যেসব নির্বাচন হয়েছে, তার মধ্যে কোনো কোনো নির্বাচন সঠিক হয়েছে- কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিতর্কিত হয়েছে। বিশেষ করে দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদের যে নির্বাচন করা হয়েছে তা দেশে ও বিদেশে অত্যন্ত বিতর্কিত হয়েছে। এ ধারার নির্বাচনী ব্যবস্থা থেকে মানুষের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনতেই তাদের আন্দোলন।

তিনি জানান, বিএনপি একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল। সব ধরনের রাজনৈতিক পরিবর্তিত পরিস্থিতি মোকাবিলা করার মতো মেধাবী ও প্রজ্ঞাবান তরুণ নেতৃত্ব দলে বিদ্যমান। দলের চেয়ারপারসন দেশনেত্রী খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে দলের রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালিত হচ্ছে।

তিনি জানান, স্বাধীনতার পরবর্তী সময়গুলো থেকে তিনি একাধিকবার মনোনয়ন পেয়েছেন, মন্ত্রীও ছিলেন। আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি কাজ করার সুযোগ রয়েছে। যেমনটি বিশ্ব রাজনীতিতে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব অনেক। তেমনি নাগরপুর-দেলদুয়ার এলাকাটি অবস্থানগত দিক দিয়ে যথেষ্ট অধিক গুরুত্বপূর্ণ। দল যাকে যোগ্য মনে করবে তাকেই মনোনয়ন দেবে। তারা সবাই মিলেমিশে কাজ করে দলীয় প্রার্থীকে নির্বাচিত করবেন।

এদিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি দলীয় মনোনয়ন পেতে মাঠে রয়েছেন, জেলা বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি রবিউল আওয়াল লাভলু, অ্যাডভোকেট আলী ইমাম তপন, কেন্দ্রীয় কৃষক দলের নির্বাহী সদস্য ডক্টর আমিনুল ইসলাম মঞ্জু, দেলদুয়ার উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এসএম ফেরদৌস আহমেদ, নাগরপুর উপজেলা বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট ইকবাল হোসেন খান, জেলা বিএনপির সদস্য ব্যারিস্টার সাদাত খান, নাগরপুর সরকারি কলেজের সাবেক ভিপি শরীফ উদ্দিন আরজু।

দীঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকলেও বিএনপির মধ্যেও রয়েছে দলীয় কোন্দল। উপজেলা বিএনপির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব নিরসন করতে না পারলে আসনটি পুনরুদ্ধার করা কঠিন হবে বলে মনে করছেন বিএনপি ঘরানার রাজনৈতিক মহল। এ ছাড়া জাতীয় পার্টি কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাহী সদস্য মামুনুর রহিম সুমন সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে তৎপরতা চালাচ্ছেন। তিনি দুই উপজেলার দর্শনীয় স্থানে পোস্টার-ব্যানার ঝুলিয়ে প্রার্থিতা জানান দিচ্ছেন-গণসংযোগ করছেন।

প্রসঙ্গত, টাঙ্গাইল-৬ (নাগরপুর-দেলদুয়ার) আসনের নাগরপুর উপজেলার ১২টি ইউনিয়নে মোট ভোটার দুই লাখ ২৯ হাজার ২৬১ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার এক লাখ ১৩ হাজার ৬৭৯ এবং নারী ভোটার এক লাখ ১৫ হাজার ৫৮২ জন। দেলদুয়ার উপজেলার ৮টি ইউনিয়নে মোট ভোটার এক লাখ ৭১ হাজার ৯০৯। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৮৬ হাজার ২৪৬ ও নারী ভোটার সংখ্যা ৮৫ হাজার ৬৬৩ জন। এ উপজেলায় একজন তৃতীয় লিঙ্গের ভোটারও রয়েছেন।

আগামীকাল : টাঙ্গাইল-৭ আসনের বিস্তারিত

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে