সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

কৃত্রিমভাবে মোটাতাজা করা গরু কিনে প্রতারিত ক্রেতারা

হাটের্ যাবের অভিযান শুরু
আলতাব হোসেন
  ২৭ জুন ২০২৩, ০০:০০

কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে কৃত্রিমভাবে গরু মোটাতাজাকরণের ভয়ংকর বিষাক্ত খেলায় মেতে ওঠে একশ্রেণির অতিলোভী খামারি। ঈদের দুই থেকে আড়াই মাস আগে রোগাক্রান্ত ও শীর্ণকায় গরু কম টাকায় কিনে বিষাক্ত হরমোন, ইনজেকশন ও রাসায়নিক ওষুধ প্রয়োগ করে গরুকে মোটাতাজা করে। বেশি মুনাফার লোভে অসাধু ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত ডোজ ব্যবহার করে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বড় করে গরুগুলো কোরবানির হাটে তোলে। গরুর শরীরের পরতে পরতে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় স্টেরয়েড, হরমোন কিংবা তার চেয়েও ভয়ংকর সব রাসায়নিক। এসব গরুর মাংস খেলে লিভার, কিডনি, হূদযন্ত্র ক্ষতিগ্রস্তসহ মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

কৃত্রিম উপায়ে গরু মোটাতাজা করা প্রতারকচক্রের বিরুদ্ধের্ যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান শুরু হয়েছে। সোমবার গাবতলীর পশুর হাটে থেকে এ অভিযান শুরু হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেনর্ যাব সদর দপ্তরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। তিনি জানান, প্রতিদিন গরুর হাটে এ অভিযান অব্যাহত থাকবে। এই টিমের সঙ্গে স্বাস্থ্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা থাকবেন।

প্রাণিসম্পদ বিশেষজ্ঞ ডক্টর আজিজুল ইসলাম বলেন, গরুকে নিয়মমাফিক খাদ্য দিয়ে মোটাতাজা করলে তার মাংস ক্ষতির কারণ হয় না। কিন্তু স্টেরয়েড দিয়ে মোটা করা গরুর মাংস ক্ষতিকর। স্টেরয়েড মূলত হাঁপানির চিকিৎসায় ব্যবহূত হয়। কিন্তু এ জাতীয় ওষুধ যেমন- ডেক্সামেথাসন বা ডেকাসন, বেটামেথাসন ও পেরিঅ্যাকটিন অতিরিক্ত মাত্রায় দিলে গরুর কিডনি ও যকৃতের কার্যকারিতা নষ্ট হওয়ায় শরীর থেকে পানি বের হতে পারে না। এ কারণে শোষিত হয়ে পানি সরাসরি গরুর মাংসে চলে যায়। ফলে গরুকে মোটাতাজা দেখায়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, খোদ প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কিছু কর্মকর্তা গরুকে নাদুসনুদুস ও মোটাতাজা করতে খামারিদের হাতে তুলে দিচ্ছেন বিষাক্ত রাসায়নিক। অধিদপ্তরের বর্তমান ও অবসরে যাওয়া কর্মকর্তারা নিজেরাই গড়ে তুলেছেন অননুমোদিত ভয়ংকর রাসায়নিকের ওষুধ কোম্পানি। এসব কোম্পানির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক করা হয়েছে তাদের স্ত্রী ও নিকটাত্মীয়দের। প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাদের গাড়িতে করেই সারা দেশের খামারে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে বিষাক্ত ওষুধ। অনেক এলাকায় স্থানীয় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা খামারিদের এসব বিষাক্ত হরমোন, ইনজেকশন ও রাসায়নিক ওষুধ ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছেন।

জানা যায়, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ১৬ কর্মকর্তার এ সিন্ডিকেট প্রতি বছর গরু মোটাতাজা করার বিষাক্ত রাসায়নিক বিক্রি করে দেড় থেকে দুই মাসে শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেন।

এ বছর গরু মোটাতাজা করণে যেসব বিষাক্ত রাসায়নিক ওষুধ ব্যবহার করা হয়েছে তা হলো- মাল্টিভিট ৫০, কাউ হেলথ কেয়ার, স্কাই এগ্রোভেট বাংলাদেশ লিমিটেড, এনিমেল কিউর লাইফ, বুস্টার বিডি, হ্যামোজেন থ্রি পস্নাস, ফ্রিজিয়ান গ্রোথ হরমোন, টলমিক বি-পস্নাস, ডরমা পস্নাস, চায়না ভিট, এলডিফোজ, জাম্পু কাউ, লাইফ পস্নাস ও বুস্টার ডোজ। এ ছাড়াও চীন ও ভারত থেকে চোরাই পথে আসা বিষাক্ত রাসায়নিক দিয়ে গরু মোটাতাজার ওষুধ ও ইনজেকশন তৈরি করা হচ্ছে। ওষুধ প্রশাসন কর্তৃপক্ষের লাইসেন্স ছাড়াই এসব ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাত করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।

এ বিষয়ে খামার সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম রতন বলেন, এসব রাসায়নিক ওষুধ নিষিদ্ধ হলেও গরুর খামার আছে, এমন এলাকার মনিহারি দোকানে এ ধরনের ওষুধ প্রকাশে পাওয়া যায়। খামারিরা দোকান থেকে সহজেই ওষুধ কিনে গরুর শরীরে প্রয়োগ করছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অসাধু গরু ব্যবসায়ী ও খামারিরা শতকরা ১০ থেকে ১৫ শতাংশ গরুর শরীরে স্টেরয়েড হরমোন ব্যবহার করছেন। এবার মোটাতাজাকরণে স্টেরয়েড আইটেমের ডেক্সামেথাজন গ্রম্নপের বিভিন্ন ইনজেকশন প্রয়োগ হয় বেশি। একটি ট্যাবলেটের দাম মাত্র ২০ টাকা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নোভিটা গ্রম্নপের এডাম-৩৩ এবং ওরাডেক্সেন খামারিরা বেশি কিনেন। ডেল্টা ফার্মার ডেকাট্রন বিক্রি হয় বেশি। এছাড়া রয়েছে নোভিটা কোম্পানির রোক্সডেক্স ইনজেকশন। একটি ইনজেকশন বিক্রি হয় ৬০ টাকায়। এ ছাড়াও রয়েছে ভারতীয় বিভিন্ন কোম্পানির গরু মোটাতাজার ওষুধ।

এ বিষয়ে অধিদপ্তরের উপ পরিচালক ফিরোজ আক্তার বলেন, ঢাকার কেরানীগঞ্জ, খিলক্ষেত, মিরপুর, সাভার, রামপুরা, টঙ্গী, বাড্ডা, গাজীপুরের চান্দনা ও শ্রীপুরে এসব কোম্পানির ওষুধ তৈরি করা হয়। এর বাইরে ময়মনসিংহ, যশোর, কুষ্টিয়া, সিরাজগঞ্জ, শেরপুর, মেহেরপুর, মানিকগঞ্জ, রাজশাহী, খুলনা, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, সিলেট এলাকায় এসব কোম্পানির ওষুধ তৈরি করা হয়। এসব কোম্পানির ওষুধ বেশি বিক্রি হয়- কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, রংপুর, দিনাজপুর, নীলফামারী, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর, টাঙ্গাইল, গাজীপুর, ময়মনসিংহ ও ঢাকার আশপাশের এলাকাগুলোতে ক্ষতিকর নানা ওষুধ ও রাসায়নিক সেবনের মাধ্যমে গরু মোটাতাজা করা হয়।

এদিকে, সাভার, কেরানীগঞ্জ, আশুলিয়া, মুন্সীগঞ্জ ও নরসিংদীতে গত তিন মাসে ব্যাঙের ছাতার মতো গরু মোটাতাজাকরণের খামার গড়ে ওঠে। ঈদের বাজার ধরতে এসব খামারে রোগাক্রান্ত ও গরুকে অতিরিক্ত ডোজ ব্যবহার করে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে মোটা করা হয়। গরুর শরীরের পরতে পরতে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে স্টেরয়েড, হরমোন কিংবা তার চেয়েও ভয়ংকর সব রাসায়নিক।

কয়েক বছর ধরে এসব অবৈধ ওষুধ কোম্পানিতে অভিযান চালিয়ে বন্ধ করছের্ যাব। ঢাকার ডেমরার লাইফ এগ্রোভেট বাংলাদেশ লিমিটেড নামে এক অবৈধ ওষুধ কারখানায় অভিযান চালিয়ে ১০ প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাকে আটক করের্ যাব। তারপরও প্রতিবছরই নতুন নতুন নামে গরু মোটাতাজাকরণের ওষুধ উৎপাদন করছে এসব কোম্পানি।

পশু চিকিৎসক আব্দুল হালিম বলেন, অতি মুনাফার লোভে বিষাক্ত রাসায়নিক খাইয়ে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তাজা করা গরুর মাংস খেলে লিভার, কিডনি, হূদযন্ত্র মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। স্টেরয়েড প্রয়োগ করে দ্রম্নত সময়ে বড় করা গরুর মাংস জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। জলীয় অংশ গরুর মাংসের সঙ্গে মিশে যায়। ফলে গরুকে ফুলা ফুলা ও মোটা দেখায়। এতে গরুর শরীরের চামড়া টান টান হয়ে সুন্দর দেখায়। অনভিজ্ঞ ক্রেতারা এসব গরু কিনে প্রতারণার শিকার হন। এসব গরু দ্রম্নত কোরবান না দিতে পারলে নিজে থেকেই গরু মারা যায়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে