সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

হোলি আর্টিজানে হামলায় নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা

যাযাদি রিপোর্ট
  ০২ জুলাই ২০২৩, ০০:০০
রাজধানীর গুলশানে হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার সাত বছর পূর্তিতে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত ও কর্মকর্তারা। ছবিটি শনিবার তোলা -যাযাদি

ঢাকার অভিজাত এলাকা গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় নিহত ব্যক্তিদের উদ্দেশে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দূতাবাসের কর্মকর্তাসহ সর্বস্তরের মানুষ। শনিবার ছিল এ হামলার সাত বছর পূর্তি।

গুলশানের ৭৯ নম্বর সড়কের ৫ নম্বর পস্নটের ওই ভবনের সামনে এদিন সকাল সাড়ে নয়টায় অস্থায়ী বেদিতে প্রথমেই ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় কুমার ভার্মা। তারপর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন জাপানের রাষ্ট্রদূত ইওয়ামা কিমিনোরি। এ ছাড়া ইতালি ও যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের কর্মকর্তারাও নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

এদিকে, শনিবার গুলশানে হলি আর্টিজান হামলায় শহীদ দুই পুলিশ সদস্যের মু্যরালে শ্রদ্ধা জানান ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুকসহ ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা। এ সময় হামলায় নিহতদের সবাইকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে এক মিনিট নীরবতা পালনের মধ্য দিয়ে স্মরণ করা হয়।

আনুষ্ঠানিকতা শেষে ডিএমপি

কমিশনার বলেন, সাত বছর আগের এই দিনে হলি আর্টিজানে বিদেশি নাগরিকদের উপর অতর্কিত হামলা করে তাদের জিম্মি ও হত্যা করে জঙ্গিরা। তাদের উদ্ধার করতে গিয়ে পুলিশের দু'জন সাহসী সদস্য শহীদ হন। ঘটনাটি আজও আমাদের মনে দগ্ধ ঘায়ের মতো জ্বলে।

তিনি আরও বলেন, দেশ থেকে জঙ্গিবাদ পুরো নিশ্চিহ্ন হয়নি। তবে জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে আছে। দেশি-বিদেশি আন্তর্জাতিক চক্রান্তে বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রাকে স্তব্ধ করতেই ২০১৫-১৬ সালে জঙ্গি হামলা ঘটানো হয়। হলি আর্টিজান হামলার পর বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগীরা কাজ বন্ধ করে দেন। তারা ভয়ে দেশ ছেড়ে চলে যেতে থাকেন। এমন ঘটনার পর পুলিশ ও জনগণ জঙ্গিদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। বাংলাদেশ থেকে জঙ্গিদের উৎখাত করা হবে ঘোষণা করা হয়। একই সঙ্গে চলে যাওয়া বিদেশিদের দেশে ফেরত আসার আহ্বান জানানো হয়। ধারাবাহিক অভিযানে জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে এলে বিদেশিদের মনে আস্থার সৃষ্টি হয়। তারা আবার ফিরে আসেন। এরপর থেকেই জঙ্গিদের নিয়ন্ত্রণ, গ্রেপ্তার ও বিচারের আওতায় আনা অব্যাহত আছে। জঙ্গি হামলার ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার তদন্ত শেষে ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে। যদিও জঙ্গি হামলার ঘটনায় অভিযুক্ত অনেকেই বিভিন্ন সময় জঙ্গি হামলা করতে গিয়ে পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলিতে মারা গেছেন। বাকি অভিযুক্তদের সাজা হয়েছে। দেশে জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে আছে। ভবিষ্যতে জঙ্গিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।

এক প্রশ্নের জবাবে ডিএমপি কমিশনার বলেন, জেএমবি, নব্য জেএমবিসহ দেশে জঙ্গিবাদ নেই বললেই চলে। তবে জঙ্গিবাদের সুপ্ত বীজ লুকিয়ে থাকতে পারে। সম্প্রতি নতুন কয়েকটি জঙ্গি সংগঠন তৈরি করার চেষ্টা করা হয়েছিল। এর মধ্যে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া একটা। সংগঠনটির ডাকে অনেক তরুণ হিযরতের নামে পাহাড়ে গিয়ে জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিয়েছিল। পুলিশ-র?্যাব তাদের অনেককে গ্রেপ্তার করেছে। অনেকেই ভুল বুঝতে পেরে আত্মসমর্পণ করেছেন। ইতোমধ্যেই নতুন জঙ্গি সংগঠনটির প্রধান শামিন মাহফুজকে স্ত্রীসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দেশে যে নামেই জঙ্গিরা সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করুক না কেন, তা পারবে না।

আরেক প্রশ্নের জবাবে ডিএমপি কমিশনার বলেন, এন্টি টেররিজম ইউনিট (এটিইউ), সিটিটিসি ও র?্যাব জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে অভিযান পারিচালনাসহ কাজ করে যাচ্ছে। জঙ্গিদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ ও প্রাপ্ত তথ্য যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করতে নানা কর্মসূচি অব্যাহত আছে। তারই ধারাবাহিকতায় দেশের বিজ্ঞ আলেম সমাজকে ধর্মসভায় জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কথা বলার আহ্বান জানানো হয়েছে। তারা জঙ্গিবাদ বিষয়ে নানা ব্যাখ্যাও দিচ্ছেন। এতে অনেকেই ভুল পথ থেকে সরেও আসছেন।

প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশান-২ এর ৭৯ নম্বর সড়কের শেষ মাথায় গুলশান লেক লাগোয়া হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁ ও বেকারিতে জঙ্গিরা ভয়াবহ হামলা চালায়। হামলায় প্রথম দফায় নিহত হন বনানী মডেল থানার ওসি সালাহ উদ্দিন আহমেদ খান ও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার রবিউল করিম। এরপর জঙ্গিরা রেস্তোরাঁর সবাইকে পয়েন্ট টু টু বোরের অটোমেটিক রাইফেলের মুখে জিম্মি করে। তখন পবিত্র মাহে রমজানের রোজা চলছিল। জিম্মির পর জঙ্গিরা ইতালির ৯ জন, জাপানের ৭ জন, ভারতের এক জন ও তিন বাংলাদেশিকে গুলি করে ও নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করে। জঙ্গিরা ওইদিন ২২ জনকে হত্যা করে। হত্যার পর তাদের বীভৎস ছবি তুলে। হামলার দায় স্বীকার করে আইএসের নামে সাইট ইন্টেলিজেন্স নামের একটি অনলাইন পোর্টাল থেকে বিবৃতি প্রকাশিত হয়। বিবৃতিতে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের ভয়াবহ উত্থান ঘটেছে বলে দাবি করা হয়েছিল।

ওইদিন ভোরে সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডোরা 'অপারেশন থান্ডার বোল্ট' পরিচালনা করেন। অভিযানে হামলাকারী জঙ্গি নিবরাজ ইসলাম, মীর সামেহ মোবাশ্বের, রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, খায়রুল ইসলাম পায়েল ও শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল নিহত হন। অভিযানে রেস্তোরাঁর পাঁচক সাইফুল ইসলাম চৌকিদারও মারা যান। কমান্ডোরা জীবিত অবস্থায় তাৎক্ষণিকভাবে ৩ জন বিদেশিসহ ১৩ জিম্মিকে জীবিত উদ্ধার করেন। সব মিলিয়ে জিম্মি দশা থেকে ৩৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়।

হলি আর্টিজানের ঘটনায় সারা দেশে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়। অভিযানে নিহত হন হামলার সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে অন্যতম কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশি তামিম আহমেদ চৌধুরী ও তার সহযোগী সারোয়ার জাহান, মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলাম, তানভীর কাদেরী, নুরুল ইসলাম মারজান, আবু রায়হান তারেক, আব্দুলস্নাহ মোতালেব, ফরিদুল ইসলাম আকাশ, বাশারুজ্জামান চকলেট ও ছোট মিজানসহ অনেকেই। সারা দেশে ৬০টি অভিযান পরিচালিত হয়। অভিযানে মারা যান অন্তত একশ' দুর্ধর্ষ জঙ্গি।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্র ও বিস্কোরক সরবরাহ করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের খাগড়াগড়ে জেএমবির বোমা তৈরির কারখানায় বিস্ফোরণে জড়িত জেএমবির শীর্ষ নেতা হাতকাঁটা মাহফুজ। তিনি ভারতে নসরুলস্নাহ নামে পরিচিত ছিলেন। তাকে মোস্টওয়ান্টেড ঘোষণা করে ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করেছিল ভারত সরকার। পরবর্তীতে হাতকাটা মাহফুজকে ভারত সরকারের সহায়তায় বাংলাদেশে ফেরত আনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

উলেস্নখ্য, হলি আর্টিজানে হামলার এক সপ্তাহের মাথায় ২০১৬ সালের ৭ জুলাই কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় দেশের বৃহত্তম ঈদ জামাতে জঙ্গি হামলার চেষ্টাকালে বাধা পেয়ে পুলিশের উপর হামলা করে জঙ্গিরা। জঙ্গিরা বোমা মেরে চাপাতি ও কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে দুই পুলিশ কনস্টেবলকে হত্যা করে। এ সময় একটি গুলি পাশের বাড়ির জানালা ভেদ করে বিদ্ধ হলে নিজ বাড়ির উঠানে ঝর্ণা রানী ভৌমিক নামে এক গৃহবধূর মৃতু্য হয়।

২০১৭ সালের ২ জুলাই পুলিশ সদর দপ্তর গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলা এবং বড় ধরনের নাশকতা চালাতে কল্যাণপুরে জঙ্গি আস্তানা স্থাপনের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে শনাক্ত হওয়া সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচু্যত মেজর জিয়াকে মোস্টওয়ান্টেড হিসেবে ঘোষণা করে। তাকে ধরিয়ে দিতে ২০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয় পুলিশের তরফ থেকে। আজও মেজর জিয়া গ্রেপ্তার হয়নি।

প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ২ জুলাই গুলশান থানায় হলি আর্টিজানে হামলার ঘটনায় সন্ত্রাস দমন আইনে মামলাটি দায়ের করেন এস আই রিপন কুমার দাশ। তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম বিভাগের পরিদর্শক হুমায়ুন কবির ২০১৮ সালের ২৩ জুলাই মামলাটির চার্জশিট দাখিল করেন। হামলায় জড়িত মোট ২১ জন জড়িত বলে তদন্তে উঠে আসে। যার মধ্যে আসামি করা হয় জীবিত আট জনকে। ২০১৮ সালের ২৬ নভেম্বর অভিযোগ গঠন করেন আদালত। ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইবু্যনালের বিচারক মজিবুর রহমান হলি আর্টিজান মামলায় ৭ জঙ্গির ফাঁসির রায় ও একজনকে খালাস দেন। ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্তরা হচ্ছেন, রাজীব গান্ধী, আসলাম হোসেনর্ যাশ, হাদিসুর রহমান, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, মামুনুর রশিদ রিপন, শরিফুল ইসলাম খালেদ ও আব্দুস সবুর খান সোহেল মাহফুজ। মৃতু্যদন্ডের পাশাপাশি তাদের প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদন্ড দেন আদালত। খালাস পান মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান। আসামিদের অনেকেই পরবর্তীতে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিহত হন।

একই অনুষ্ঠানে ডিএমপি কমিশনার অপর এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, রাতের ঢাকাকে ছিনতাইকারীরা ছিনতাই করার উপযুক্ত সময় হিসেবে বেছে নেয়। কারণ ওই সময় রাস্তা নীরব থাকে। লোকজন ও যানবাহনের চলাচল কমে যায়। রাত ২টার পর রাস্তা নিরিবিলি হলে ছিনতাইকারীরা এমন জনমানবহীন রাস্তাকে ছিনতাইয়ের সুযোগ হিসেবে বেছে নেয়। গত শুক্রবার রাতে ঢাকার ফার্মগেটে সেজান পয়েন্টের সামনে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে পুলিশ সদস্যের নিহতের ঘটনাটি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। হত্যাকারীদের পাশাপাশি ছিনতাইকারীদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত আছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে