শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অবহেলায় জরাজীর্ণ জাতীয় মসজিদ

যাযাদি ডেস্ক
  ০৬ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০
জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের একাংশ -ফাইল ছবি

বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ হলেও যত্নের অভাবে এখন জরাজীর্ণ। মসজিদের ভেতরে-বাইরে চোখে পড়বে ময়লা-আবর্জনা। মসজিদে প্রবেশের একাধিক গেট ভাঙা। টয়লেটগুলো ব্যবহার উপযোগী নয়। বৃষ্টির দিনে কোথাও কোথাও জমে পানি। ভবনের বাইরে দেয়ালে রং ঝলসে গেছে, কোথাও পোস্টারে ঢাকা। পার্কিংয়ের জায়গা থাকলেও মুসলিস্নরা গাড়ি রাখার সুযোগ পান না বলে অভিযোগ রয়েছে। এমন পরিস্থিতির জন্য মসজিদটির দেখভালের দায়িত্ব থাকা ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে দুষছেন মুসলিস্নরা।

পবিত্র কাবা শরিফের আদলে নির্মিত এ মসজিদটি সারাদেশের মুসলিস্নদের কাছে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। পর্যটন করপোরেশনের ওয়েব সাইটে বায়তুল মোকাররম প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের বিশিষ্ট শিল্পপতি লতিফ বাওয়ানি ও তার ভাতিজা ইয়াহিয়া বাওয়ানির উদ্যোগে এই মসজিদ নির্মাণের পদক্ষেপ নেওয়া হয়। আব্দুল লতিফ ইব্রাহিম বাওয়ানি প্রথম ঢাকায় বিপুল ধারণক্ষমতাসহ একটি গ্র্যান্ড মসজিদ নির্মাণের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। ১৯৫৯ সালে 'বায়তুল মোকাররম মসজিদ সোসাইটি' গঠনের মাধ্যমে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। পুরান ঢাকা ও নতুন ঢাকার মিলনস্থলে মসজিদটির জন্য জায়গা অধিগ্রহণ করা হয়। স্থানটি নগরীর প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র থেকেও ছিল কাছে। বিশিষ্ট স্থপতি টি আব্দুল হুসেন থারিয়ানিকে মসজিদ কমপেস্নক্সটির নকশার জন্য নিযুক্ত করা হয়। পুরো কমপেস্নক্স নকশার মধ্যে দোকান, অফিস, লাইব্রেরি ও গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

ইসলামিক ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, ৮ দশমিক ৩০ একর জায়গাজুড়ে বায়তুল মোকাররম মসজিদ। ১৯৬০ সালের ২৭ জানুয়ারি বায়তুল মোকাররম মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। ১৯৬৩ সালের ২৫ জানুয়ারি মসজিদটিতে নামাজ পড়া শুরু হয়। ১৯৮২ সালে সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বায়তুল মোকাররম মসজিদকে জাতীয় মসজিদ হিসেবে ঘোষণা করেন।

সরেজমিন দেখা যায়, বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ হলেও সর্বত্র অযত্নের ছাপ। এর প্রবেশ পথ রয়েছে ছয়টি। তবে বেশিরভাগ মুসলিস্ন প্রবেশ করেন উত্তর ও দক্ষিণ গেট দিয়ে। এর মধ্যে উত্তর পাশের গেট ভাঙা, গেটের চারপাশে ময়লা-আবর্জনা। মসজিদের পূর্ব দিকের গেটটি মূল ফটক হওয়ার কথা থাকলেও সেটির নির্মাণকাজ পুরোপুরি

শেষ হয়নি। বরং ?পূর্ব পাশের গেটের চারপাশ পরিণত হয়েছে ডাস্টবিনে। মসজিদের ভেতরের পরিবেশও অপরিচ্ছন্ন, কোথাও দেয়ালের রঙ ঝলসে গেছে, পস্নাস্টার খসে পড়ছে। মসজিদের চারপাশে মার্কেট ছাড়াও রয়েছে ভ্রাম্যমাণ দোকান। যে কারণে পরিবেশ ঘিঞ্জি হয়ে থাকে।

ব্যালকনিসহ সাততলা ভবনের এই মসজিদটি ৩৫ হাজার মুসলিস্ন ধারণে সক্ষম। এর মধ্যে রয়েছে নারীদের জন্য পৃথক ব্যবস্থা, যেখানে পাঁচ হাজার নারী নামাজ আদায় করতে পারেন। তবে বায়তুল মোকাররম মসজিদের ভেতরে থাকা মার্কেটের মধ্য দিয়ে নারীদের প্রবেশ পথ থাকায় ভিড় ঠেলে প্রবেশ করতে হয়। সাততলা ভবনের বিভিন্ন তলায় মেঝে ময়লা, দেয়ালের রঙ ঝলসে গেছে।

মসজিদে একসঙ্গে ৪৫০ জন মুসলিস্নর ওজু করার ব্যবস্থা রয়েছে। মসজিদের বিভিন্ন স্থানে ৬১টি প্রস্রাবখানা ও ৯৬টি টয়লেট রয়েছে। তবে বাস্তবে মসজিদটির বেশিরভাগ টয়লেট ব্যবহার উপযোগী নয়। কোনো কোনো টয়লেট এতই নোংরা যে, দুর্গন্ধে পাশ দিয়ে চলাচল করাও কঠিন। কোনো কোনো টয়লেটে কমোড ভাঙা, নেই পানির ট্যাপ। অজুখানাগুলোও অপরিচ্ছন্ন।

মসজিদটিতে ৬৮ মিটার উচ্চতার একটি মিনার রয়েছে। এছাড়া গম্বুজ রয়েছে তিনটি। মোট এক লাখ ২৮ হাজার ৯০০ বর্গফুট আয়তনের রয়েছে পার্কিং ব্যবস্থা। এর মধ্যে দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে ৮৮ হাজার ৯০০ বর্গফুট, উত্তর পূর্ব দিকে ৪০ হাজার বর্গফুটের পার্কিং ব্যবস্থা। মসজিদটিতে পরিচালনা ও নামাজ পড়ানোর জন্য তিনজন কর্মকর্তা, একজন খতিব, চারজন ইমাম, তিনজন মুয়াজ্জিন এবং ২২ জন খাদেম ও কর্মচারী রয়েছেন।

সৌদি আরবের অর্থায়নে ২০০০ সালে বায়তুল মোকাররম মসজিদের সম্প্রসারণ ও সৌন্দর্যবৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়। সে বছর ২৫ ফেব্রম্নয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মূল মসজিদের দক্ষিণাংশের সম্প্রসারণ, নান্দনিক মিনার নির্মাণ, পূর্ব চত্বরের খোলা অংশের আচ্ছাদিতকরণ, বেজমেন্ট কারপার্ক নির্মাণ, ওজুখানা ও টয়লেট নির্মাণ দক্ষিণ দিকে সুউচ্চ গেট নির্মাণ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। কাজ শেষে ২০১০ সালের ২৯ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী সেগুলো উদ্বোধনও করেন।

তবে সম্প্রসারণ-সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা হলেও অযত্নে অবহেলায় জরাজীর্ণ অবস্থায় সৃষ্টি হয়েছে। বায়তুল মোকাররমে মসজিদে থাকা দোকান নিয়ে সবচেয়ে বেশি আপত্তি মুসলিস্নদের। মার্কেটের কারণে মসজিদের চারপাশজুড়ে হট্টগোল। বাইরে থেকে মসজিদের চেয়ে মার্কেটই বেশি নজরে আসে। মসজিদটিতে ৮৫৫টি দোকান রয়েছে। এসব খাতে ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে বায়তুল মোকাররমের আয় দুই কোটি ৪৭ লাখ ২৮ হাজার টাকা। বায়তুল মোকাররম মসজিদ পরিচালনায় বছরে প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা খরচ হয়। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে মসজিদের ব্যয় হয়েছে পাঁচ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ফান্ড থেকে ব্যয় হয়েছে চার কোটি টাকা, সরকারি অনুদান এক কোটি ৪৬ লাখ টাকা।

জামিয়া কোরআনিয়া আরাবিয়া লালবাগ মাদ্রাসার শিক্ষক ও ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মুফতি ফয়জুলস্নাহ বলেন, 'জাতীয় যে কোনো বিষয় বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। মসজিদ হিসেবে স্বাভাবিকভাবে মুসলিস্নদের জন্য ওজু, নামাজের সুন্দর ব্যবস্থা থাকা জরুরি। একই সঙ্গে বাহ্যিকভাবে অবকাঠামোও আকর্ষণীয় থাকা উচিত। কিন্তু জাতীয় মসজিদের চারপাশে মার্কেট করা হয়েছে। মার্কেটের যন্ত্রণা মসজিদকে ঘিরে ধরেছে। মসজিদ এমনিতেই মানুষের কাছে ভিন্ন গুরুত্ব বহন করে। জাতীয় মসজিদ হিসেবে এটির গুরুত্ব আরও বেশি। তাই এ মসজিদকে ঘিরে যত অবস্থাপনা রয়েছে তা দূর করা দরকার। সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে অবকাঠামোর উন্নয়ন প্রয়োজন। মসজিদকে ঘিরে যে বাণিজ্য গড়ে উঠেছে তা বন্ধ করা দরকার।'

জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হিসেবে এই মসজিদের চারপাশে হকার উচ্ছেদে মসজিদ কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে কিনা জানতে চাইলে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পরিচালক (মসজিদ ও মার্কেট বিভাগ) মহিউদ্দিন মজুমদার বলেন, 'মসজিদের বাইরের অংশ আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এ বিষয়ে আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছি।'

পল্টন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবু বকর সিদ্দিক এ বিষয়ে বলেন, 'প্রতিদিনই ফুটপাত থেকে হকার উচ্ছেদে অভিযান হয়। সকালে উচ্ছেদ করা হলে বিকালে আবার বসে যায়। বিকালে উঠিয়ে দিলে সকালে এসে হাজির হয়। এখানে দুই-একশ হকার হলে সহজে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতো। কিন্তু এ এলাকায় হাজার হাজার হকার। বড় ধরনের অভিযান চালাতে গেলে আবার আন্দোলন শুরু করে পরিস্থিতি ভিন্ন ধরনের হয়ে যায়। এ এলাকায় হকার উচ্ছেদে জাতীয় সিদ্ধান্ত প্রয়োজন।'

সরকারি স্থাপনা ও জাতীয় মসজিদ হিসেবে রক্ষণাবেক্ষণের নিয়মিত উদ্যোগ আছে জানতে চাইলে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পরিচালক মহিউদ্দিন মজুমদার বলেন, 'এত বড় মসজিদ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে যে পরিমাণ জনবল দরকার তা নেই। সংস্কার কাজের জন্য আমরা মহাপরিচালককে জানিয়েছি।'

পার্কিং লটে মুসলিস্নদের গাড়ির জায়গা না হওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'আমাদের পার্কিং ব্যবস্থা উন্মুক্ত। সবাই গাড়ি রাখতে পারবেন। তবে এজন্য ফি নেওয়া হয়। সে কারণে কেউ কেউ মসজিদের যে স্থানে পার্কিং নিষিদ্ধ সেখানে গাড়ি রাখতে চেষ্টা করেন। এজন্য কেউ কেউ হয়তো অভিযোগ করতে পারেন পার্কিং নিয়ে।'

ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ আব্দুলস্নাহ বলেন, 'আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই বায়তুল মোকাররমকে গুরুত্ব দিয়ে খোঁজ-খবর নিয়েছি। যারা মসজিদটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। মসজিদটিকে কীভাবে দৃষ্টিনন্দন করা যায়, জাতীয় মসজিদ হিসেবে যথাযথভাবে যাতে সারাদেশের মানুষের কাছে উপস্থাপন করা যায় সেসব বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। স্থাপত্যবিদদের মাধ্যমে পর্যালোচনা করা হচ্ছে কোথায় কী ধরনের পরিবর্তন, সংস্কার করা যায়। তাদের পরামর্শ নিয়ে একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করে কাজ শুরু হবে। তখন মসজিদটি নান্দনিক রূপ পাবে।' বাংলা ট্রিবিউন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<83128 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1