মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

চলছে স্নান উৎসব, ব্রহ্মপুত্র নদে লাখো পুণ্যার্থীর ঢল

চিলমারী (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি
  ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ১০:৩৮

কুড়িগ্রামের চিলমারীর ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে উৎসবমুখর পরিবেশে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অষ্টমী স্নান উৎসব চলছে। উৎসবকে ঘিরে সোমবার থেকে নদীর রমনা ঘাটে এলাকায় লাখো পুণ্যার্থীর ঢল নেমেছে। মঙ্গলবার বিকেল ৪টা ৫৬ মিনিট পর্যন্ত চলবে এ স্নান উৎসব।

স্নান উৎসব কমিটির সদস্য সচিব কর্ণধার বর্মা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, স্নান উৎসব সোমবার বিকেল ৪টা ২৪ মিনিট পর থেকে শুরু হয়েছে। তবে মূল স্নান মঙ্গলবার ভোর ৪ টা থেকে শুরু হয়েছে। শেষ হবে বিকেল ৪টা ৫৬মিনিটে। পূজা উদ্যাপন কমিটির যুগ্ম আহবায়ক মিলন চন্দ্র বর্মন জানান, এবারের স্নান উৎসবে ৫ লক্ষাধিক পুণ্যার্থী অংশ নিচ্ছেন।

চিলমারীর ব্রহ্মপুত্র নদের রমনা ঘাট থেকে জোড়গাছ ঘাটের মধ্যবর্তী স্থানে নন্দির মোড়ের ২ কি.মি এলাকা জুড়ে এ উৎসব পালিত হচ্ছে। উৎসবকে নির্বিঘ্ন করতে ১৪০ জন পুলিশ সদস্যের পাশাপাশি উৎসব কমিটির পক্ষ থেকে ১৩০ জন স্বেচ্ছাসেবক সহযোগীতা করছেন।

পুণ্যার্থীদের জন্য ৩০টি শৌচাগার, পানির ব্যবস্থার জন্য ২০টি নলকূপ, কাপড় পরিধানের জন্য ৭০টির বেশি বুথ স্থাপন করা হয়েছে। পাশাপাশি কন্ট্রোল রুমে মেডিকেল টিম তাৎক্ষণিক চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছেন।

চিলমারী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. মিনহাজুল ইসলাম জানান, প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমরা সবসময় নজরদারি রাখছি, খোঁজ নিচ্ছি। যাতে ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে নির্বিঘ্নে অষ্টমীর স্নান অনুষ্ঠিত হয়।

যে কারণে অষ্টমীর স্নান: প্রতি বছর চৈত্র মাসের শুল্ক পক্ষের অষ্টমী দিনে এই মেলাটি হয় বলে এই মেলার নামকরণ করা হয়েছে “অষ্টমীর মেলা”। জমদগ্নি ঋষির পুত্র ছিল ভূন্ডুরাম। হিন্দু শাস্ত্র ‘চৈতন্যম্মৃত’ মতে জানা যায়, এই জমদগ্নি ঋষির নিবাস স্থল ছিল বগুড়ার মহাস্থান গড়ে। তিনি খুব গুণী ঋষি ছিলেন। এক দিন জন্মদগ্নি ঋষি তার পুত্র ভূন্ডুরাম কে ডেকে বললেন ‘পুত্র, আমি কি তোমার পিতা? প্রশ্ন শুনে ভূন্ডুরাম অবাক হলেন এবং মাথা ঝাঁকিয়ে দিয়ে বললেন হ্যাঁ, অবশ্যই তুমি আমার পিতা। তখন জমদগ্নি ঋষি পুত্রের নিকট এসে অত্যন্ত সোহাগের সাথে বললেন ‘আমি যদি তোমাকে কোন কঠোর নির্দেশ প্রদান করি, তা কি তুমি পালন করবে ভুন্ডুরাম পূর্বের মতো এবারেও ভূন্ডুরাম মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জ্ঞাপন করলে জমদগ্নি তাকে নির্দেশ দিলেন ‘যাও, এই মুহূর্তে কুঠার দিয়ে তোমার মাতা ও চার ভ্রাতাকে হত্যা কর’।

পিতার এমন অমানবিক নির্দেশ শুনে ভূন্ডুরাম কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে গেল। জমদগ্নি ঋষি পুত্রকে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আবারও বলেন ‘যাও পুত্র পিত্রাদেশ পালন কর, নচেৎ তুমি আমার কঠিন অভিশাপে অভিশপ্ত হবে’। উপায় অন্ত খুঁজে না পেয়ে অবশেষে ভূন্ডুরাম কুঠারের আঘাতে মা ও অপর চার ভাইকে হত্যা করল। কিন্তু একি কুঠার তো আর হাত থেকে পড়ছে না। ভূন্ডুরাম তখন ওই অবস্থায় পিতৃচরণে লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে লাগলো এবং বলতে লাগলো ‘পিতা আমি তো পিত্রাদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি, এবার তুমি তোমার গুণের বলে আমার মা ও চার ভ্রাতাকে জীবিত করে দাও। পুত্রের কান্না দেখে পিতার মন অবশেষে শীতল হল, ঋষি তার মৃত স্ত্রী ও চার পুত্রের জীবন দান করলেন। একটি সমস্যার সমাধান হলেও ভূন্ডুরামের হাত থেকে কুঠার খুলছে না। আবার ভূন্ডুরাম পিতার চরণে মাথা রাখলেন, বললেন ‘পিতা আমার হাত থেকে কুঠার পড়ছে না’? তুমি মাতৃহত্যা করার পাপে অভিশপ্ত পুত্র। অভিশাপ মোচন না হওয়া পর্যন্ত কুঠার তোমার হাত থেকে পড়বে না বৎস।

পুত্র ভূগুরাম পিতার চরণে পুনরায় মাথা ঠুকতে লাগলেন এবং বলতে লাগলেন হে পিতা, এ অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবো কীভাবে তুমি বলে দাও’।

অবশেষে জমদগ্নি ঋষি বললেন, তুমি যদি এ অভিশাপ থেকে পরিত্রাণ পেতে চাও, তাহলে তোমাকে ওই কুঠার হাতে নিয়ে সম¯Í পীঠস্থান ভ্রমণ করতে হবে এবং সম¯Í পীঠস্থান ভ্রমণ শেষে যেতে হবে কোশলের বিষ্ণুদশা নামে পরিচিত দ্বিজের নিকট। তবেই তিনি তোমার এ অভিশাপ মোচনের পথ দেখিয়ে দিবেন।

কি আর করা? অবশেষে ভূন্ডুরাম পিতার পরামর্শ মত নিজ শরীরের সাথে আটকে যাওয়া অভিশপ্ত কুঠারটি নিয়ে চষে বেড়াতে লাগল গোটা ভারতবর্ষে যতগুলো পীঠস্থান আছে সর্বত্র। পৌঁছে যায় বিষ্ণুদশা দ্বিজের নিকট। বিষ্ণুদশা ভূন্ডুরামের অভিশপ্ত হবার সম¯Í কাহিনি মনোযোগ দিয়ে শুনলেন এবং বললেন, যাও মানস্ সরোবরে। সেখানে গিয়ে পর্বত কেটে হ্রদ সৃষ্টি কর। যে দিন তুমি পর্বত কেটে সৃষ্ট হ্রদের সেই জলে স্নান করতে পারবে, ওই দিনই হবে তোমার মুক্তি।

ভূন্ডুরাম ছুটে চললো মানস সরোবরে এবং সেখানে পৌঁছে পর্বত কাটতে লাগলো। এভাবেই দিনের পরদিন, রাতের পর রাত বিরামহীনভাবে পর্বত কাটতে কাটতে একদিন ব্রহ্মপুত্র হ্রদ সৃষ্টি হলো, জলের স্রোত ডুবে গেল ভূন্ডুরাম।

কথিত আছে যে, ভূন্ডুরাম পর্বতের পাদ্বদেশে ডুবে যাবার পর চিলমারী উপজেলার ব্রহ্মপুত্র নদের ত্রি-স্রোতের মাঝে ভেসে উঠেন এবং তার হাত থেকে কুঠার পড়ে যায়। ভূন্ডুরাম মাতৃহত্যার অভিশাপ থেকে মুক্তি পান। ঐদিনটি ছিল চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমী তিথি। সেই থেকে এই ধর্মের অনুসারীগণ জীবনের সকল পাপ মোচনের জন্য প্রতি বছর নির্দিষ্ট এই দিনটিতে স্নানের জন্য ছুটে আসেন চিলমারীতে। (মহাভারত, পৃষ্টা-১০০৩ শেখক শ্রী কাশিরাম দাস)।

যাযাদি/ এসএম

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে