মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

কুড়িগ্রামের চিলমারীতে অষ্টমীর স্নানে লাখো পূণ্যার্থীর ঢল

চিলমারী (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি
  ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৭:৫৩

কুড়িগ্রামের চিলমারীতে ঠাকুর-দেবতার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে ব্রহ্মপূত্র নদে স্নান করে পাপ মোচনের জন্য লাখো পূণ্যার্থীর আগমন ঘটেছে। মঙ্গলবার ভোর ৪টা ২০মিনিট থেকে বিকেল ৪টা ৫৬মিনিট পর্যন্ত মূল সময়কে ধরে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত ছাড়াও পাশ্ববর্তী ভারত, চীন ও নেপাল থেকে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ঐতিহ্যবাহি এ স্নানে সামিল হন।

অষ্টমীর স্নান উপলক্ষে গত তিনদিন ধরে চিলমারীতে শুরু হয় নানান ধর্মের মানুষের আগমন। প্রায় ৩ কিলোমিটার এলাকা ব্যাপি ব্রহ্মপূত্র নদে বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষের স্নানের মধ্যদিয়ে সকল পাপ মুছে ফেলার জন্য প্রার্থনা করেন তারা।

মঙ্গলবার মেলায় আসতে গিয়ে দেখা যায় নানান অসঙ্গতি। উলিপুর পৌরসভা এলাকায় টোলের নামে পূণ্যার্থীদের অটো থেকে জোড় করে ১৫টাকা আদায় করা হচ্ছে। অতিরিক্ত টাকা দিতে না চাওয়ায় সেখানে যানজট তীব্র আকার ধারণ করছে। চিলমারীর রমনাবাজার এলাকায় প্রতিটি মোটর সাইকেলের জন্য নেয়া হচ্ছে ৫০টাকা।

মেলা প্রাঙ্গনে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা হকারদের কাছ থেকে কিছু যুবক পাহারা দেয়ার নামে জোড় করে ১০ থেকে ২০টাকা করে আদায় করে নিচ্ছে। এছাড়াও তিন মাইল ব্যাপী অষ্টমীর স্নান এলাকার মূল জায়গা জোড়গাছে নারীদের জন্য বুথ, লেট্রিন সুবিধা ও নলকূপের মাধ্যমে পানির ব্যবস্থা থাকলেও জোড়গাছ থেকে চিলমারী নৌঘাট পর্যন্ত এলাকায় এ ধরণের সুবিধা রাখা হয়নি।

এছাড়াও মহিলাদের কাপড় পাল্টানোর জন্য কোন বুথ না থাকায় বিড়ম্বনায় পরেছেন নারী পূণ্যার্থী ও তাদের সঙ্গীরা।

গাইবান্ধার বামনডাঙ্গা মন্মথ এলাকার বাসিন্দা সুরোবালা জানান, কোন ব্যবস্থা না থাকায় লোকজনের সামনেই কাপড় পাল্টাতে হচ্ছে। আমাদের খুবই লজ্জ্বা লাগছে। কিন্ত কিছুই করার নেই।

সুদূর পঞ্চগড় থেকে ৬টি মিনিবাস নিয়ে প্রায় সাড়ে ৪শতাধিক পূণ্যার্থী এসেছেন। তাদের মধ্যে বোদা থানার পাঁচপীর ইউনিয়নের বৈরাতী দক্ষিণ কালিবাড়ী গ্রামের বাবুল চন্দ্র বর্মণ জানান, রাত সাড়ে ৩টায় যাত্রা করেছি। চিলমারীতে পৌঁছালাম ভোর পৌনে ৫টার দিকে। কুড়িগ্রাম থেকে চিলমারী আসতে বেশ কয়েক জায়গায় বাস থামিয়ে টাকা নেয়া হচ্ছে। প্রতিবাদ করেও কোন লাভ হচ্ছে না।

বগুড়ার নন্দীগ্রাম এলাকার জয়ারানী জানান, এবারে স্নানের জায়গা নির্দিষ্ট করায় খুব ভালো হয়েছে। এদিকের পরিবেশটা ভালো। নদীর তীরে ব্লক দেয়ায় মানুষ ধুলোবালু থেকে রক্ষা পেয়েছে। এরআগে উত্তর দিকে খোলা স্থান নির্ধারণ করায় মানুষের পায়ের ধূলায় কিছুই দেখা যেতো না। স্নান করে আবার শরীর ধূলামাখা হয়ে যেত।

লালমনিরহাটের শিয়ালখাওয়া এলাকার জিতেন্দ্রনাথ সরকার জানান, বিগত ১৯৬৯ সাল থেকে এখানে পাপ মোচনের জন্য আসছি। যুদ্ধের সময়টা বাদে পরবর্তীতে প্রতিটি বছর এখানে স্নান করে যাই। এবারের স্নানের স্থান ও ব্যবস্থাপনা খুবই ভালো হয়েছে। কিছু ত্রুটি থাকলেও আসলে কিছুই করার থাকে না।

পঞ্চগড় থেকে আসা পুরোহিত অজয় চক্রবর্তী জানান, পরশুরামের মাতৃহত্যার পাপ মোচনের জন্য ব্রহ্মপূত্র নদে এসে স্নান করেছেন। ধর্মীয় ওই রীতি মানার জন্য আমরা প্রতিবছর ব্রহ্মপূত্র নদে প্রাত:স্নান করি।

এদিকে বিশাল এ জনতাকে সামলাতে চিলমারী উপজেলা প্রশাসন থেকে নেয়া হয়েছে সব ধরণের ব্যবস্থা। এবারের স্নান চলে সারাদিনব্যাপী। পূণ্যার্থীদের আগমন উপলক্ষে নদীর তীরে বসেছে মেলা। স্নানের পর নারী-পুরুষের জন্য নেয়া হয়েছে নিরাপত্তা ব্যবস্থা।

প্রায় ২ লাখ মানুষ প্রতিবছর এ মেলায় অংশ নেয় বলে জানান বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদ, চিলমারী উপজেলা শাখার সভাপতি শচিন্দ্রই কোন নাথ বর্মন।

চিলমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মিনহাজুল ইসলাম জানান, সরকারিভাবে অষ্টমীর স্নানে মেলা স্থলে অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন, বিশুদ্ধ পানীয় জলের জন্য নলকুপ স্থাপন, মহিলাদের কাপড় বদলানোর জন্য দু’শতাধিক তাবু টানানো হয়। নিরাপত্তার জন্য পুলিশ, র‌্যাব, আনসার ও ভিডিপির পর্যাপ্ত সদস্য মোতায়েন করাসহ ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোতে পুলিশী পাহারার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে পুলিশ সুপার আল আসাদ মো. মাহফুজুল ইসলাম জানান, আমরা গত পরশু মেলা প্রাঙ্গন ঘুরে দেখেছি। সার্বিক নিরাপত্তার জন্য সেখানে পোষকধারী ছাড়াও সাদা পোষাকে নজরদারী করা হচ্ছে। এছাড়াও আমরা উপজেলা ও জেলা প্রশাসনের সাথে যৌথ প্রয়াসে নাররিকরা যাতে সুন্দরভাবে অষ্টমীর স্নান সম্পন্ন করতে পারে সেই ব্যবস্থা গ্রহন করেছি।

আমাদের এখানে পুলিশের পাশাপাশি ফায়ার সার্ভিস, ট্রাফিক ব্যাবস্থা ও ডিসপ্লে করা হয়েছে। একটি কমিটি করা আছে তাদের ভলান্টিয়াররাও কাজ করছে। যদি কোন সমস্যা সৃষ্টি হয় তা সমাধানের ব্যবস্থা করা হবে। আমাদের উদ্দেশ্য দিন শেষে সকলে যাতে হাসি মুখে বাড়ি ফিরতে পারে।

যে কারণে অষ্টমীর স্নান: প্রতি বছর চৈত্র মাসের শুল্ক পক্ষের অষ্টমী দিনে এই মেলাটি হয় বলে এই মেলাটির নামকরণ করা হয়েছে “অষ্টমীর মেলা”। জমদগ্নি ঋষির পুত্র ছিল ভূন্ডুরাম। হিন্দু শাস্ত্র ‘চৈতন্যম্মৃত’ মতে জানা যায়, এই জমদগ্নি ঋষির নিবাস স্থল ছিল বগুড়ার মহাস্থান গড়ে। তিনি খুব গুণী ঋষি ছিলেন। একদিন জন্মদগ্নি ঋষি তার পুত্র ভূন্ডুরাম কে ডেকে বললেন ‘পুত্র, আমি কি তোমার পিতা? প্রশ্ন শুনে ভূন্ডুরাম অবাক হলেন এবং মাথা ঝাঁকিয়ে দিয়ে বললেন হ্যাঁ, অবশ্যই তুমি আমার পিতা। তখন জমদগ্নি ঋষী পুত্রের নিকট এসে অত্যন্ত সোহাগের সাথে সূধালো ‘আমি যদি তোমাকে কোন কঠোর নির্দেশ প্রদান করি, তা কি তুমি পালন করবে?’ পূর্বের মতো এবারেও ভূন্ডুরাম মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জ্ঞাপন করলে জমদগ্নি ঋষী পুত্রকে নির্দেশ দিলেন ‘যাও, এই মুহূর্তে কুঠার দিয়ে তোমার মাতা ও চার ভ্রাতাকে হত্যা কর’। পিতার এহেন অমানবিক নির্দেশ শুনে ভূন্ডুরাম কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল।

জমদগ্নি ঋষী পুত্রকে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আবারও বলেন ‘যাও পিত্রাদেশ পালন কর, নচেৎ তুমি আমার কঠিন অভিশাপে অভিশপ্ত হবে’। উপায় অন্ত খুঁজে না পেয়ে অবশেষে ভূন্ডুরাম কুঠারের আঘাতে মা ও অপর চার ভাইকে হত্যা করল।

কিন্তু একি কুঠার তো আর হাত থেকে পড়ছে না। ভূন্ডুরাম তখন ঐ অবস্থায় পিতৃচরণে লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে লাগলো এবং বলতে লাগলো ‘পিতা আমি তো পিত্রাদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি, এবার তুমি তোমার গুণের বলে আমার মা ও চার ভ্রাতাকে জীবিত করে দাও।

পুত্রের কান্না দেখে পিতার মন অবশেষে শীতল হল, ঋষী মৃত তার স্ত্রী ও চার পুত্রের জীবন দান করলেন। একটি সমস্যার সমাধান তো হলো বটে, কিন্তু ভূন্ডুরামের হাত থেকে কুঠার তো আর খুলছে না। আবার ভূন্ডুরাম পিতার চরণে মাথা রাখলেন, বলনে ‘পিতা আমার হাত থেকে কুঠার পড়ছে না’? তুমি মাতৃহত্যা করার পাপে অভিশপ্ত। অভিশাপ মোচন না হওয়া পর্যন্ত কুঠার তোমার পড়বে না বৎস। পুত্র ভূগুরাম পিতার চরণে পুনরায় মাথা ঠুকতে লাগলেন এবং বলতে লাগলেন ‘ হে পিতাঃ এ অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবো কিভাবে তুমি বলে দাও‘।

অবশেষে জমদগ্নি ঋষী বললেন, তুমি যদি এ অভিশাপ থেকে ত্রাণ পেতে চাও, তাহলে তোমাকে ওই কুঠার হাতে নিয়ে সমস্ত পীঠস্থান ভ্রমণ করতে হবে এবং সমস্ত পীঠস্থান ভ্রমণ শেষে যেতে হবে কোশলের বিষ্ণুদশা নামে পরিচিত দ্বিজের নিকট।

তবেই তিনি তোমার এ অভিশাপ মোচনের পথ দেখিয়ে দিবেন। কি আর করা? অবশেষে ভূন্ডুরাম পিতার পরামর্শ মত নিজ শরীরের সাথে আটকে যাওয়া অভিশপ্ত কুঠারটি নিয়ে চষে বেড়াতে লাগল গোটা ভারতবর্ষে যতগুলো পীঠস্থান আছে সর্বত্র। বিষ্ণুদশা ভূন্ডুরামের অভিশপ্ত হবার সমস্ত কাহিনী মনোযোগ দিয়ে শুনলেন এবং বললেন, যাও মানস্ সরবরে। সেখানে গিয়ে পর্বত কেটে হ্রদ সৃষ্টি কর। যে দিন তুমি হ্রদ কেটে সেই জলে স্নান করতে পারবে। ঐদিনই হবে তোমার মুক্তি।

ভূন্ডুরাম ছুটে চললো মানস সরবরে এবং সেখানে পৌঁছে পর্বত কাটতে লাগলো। এভাবেই দিনের পর দিন, রাতের পর রাত বিরামহীনভাবে পর্বত কাটতে কাটতে একদিন ব্রহ্মপুত্র হ্রদ সৃষ্টি হলো, জলের স্রোতে ডুবে গেল ভূন্ডুরাম। কথিত আছে যে, ভূন্ডুরাম পর্বতের পাদদেশে ডুবে যাবার পর চিলমারী উপজেলার ব্রহ্মপুত্র নদের ত্রি-স্রোতের মাঝে ভেসে উঠেন এবং তার হাত থেকে কুঠার পড়ে যায়। ভূন্ডুরাম মাতৃহত্যার অভিশাপ থেকে মুক্তি পান। ঐদিনটি ছিল চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমী তিথি। সেই থেকে এই ধর্মের অনুসারীগণ জীবনের সকল পাপ মোচনের জন্য প্রতি বছর নির্দিষ্ট এই দিনটিতে স্নানের জন্য ছুটে আসেন চিলমারীতে।

মেলায় পূন্যার্থীরা যা করেন: এই দিনটিতে শত শত হিন্দু সম্প্রদায়ের নরসুন্দররা চলে আসে স্নান কেন্দ্রে। তারা সবাই নদীর পানির নিকটবর্তী উপকন্ঠে বালুর উপর পীড়ি পেতে বসেন সারিবদ্ধ হয়ে। পুণ্যার্থীরা সেলাই বিহীন বস্ত্র পড়ে (ধুতি) প্রথমে জলে নেমে শরীর ভিজিয়ে নেন এবং ভেজা শরীরে এসে কুশান পেতে বসে নর-সুন্দরের সামনে।

অবশ্য মাথা নেড়ে করবার পূর্বে কিছু শাস্ত্রীয় ব্যাপার রয়েছে। এর জন্য পূণ্যার্থীকে সংগ্রহ করে আনতে হয় আগরবাতি, কলার কচি পাতা, বেল পাতা, ফুল, তুলশি পাতা, আতব চাল আর মালভোগ বা শবরী কলা। এসব একটি পাত্রে ঘেটে মেখে তৈরি করা হয় প্রসাদ। প্রতিটি নর-সুন্দরের পার্শ্বেই শাস্ত্রীয় দিকটি দেখবার জন্য একজন ব্রাম্মণ।

এই দিকগুলি ঐ ব্রাম্মণরা করে থাকেন। যখন নর-সুন্দর ব্যক্তিটি মাথা নেড়ে করতে থাকেন তখন ব্রাম্মন নর-সুন্দর ব্যক্তিটিসহ পূণ্যার্থীর মাথার উপরে এবং শরীরে মন্ত্র পরে ঐ সকল ফুল, ঘাস ইত্যাদি ছিটিয়ে আত্মার শুদ্ধি করে থাকেন।

এসময় অনেক পূর্ণ্যাথী আবার সমস্ত মাথা নেড়ে করে সামান্য একটু মাঝের চুল রেখে দিয়ে টিকি তৈরী করে সেখানে ফুল বেঁধে নেয়। অতঃপর পূণ্যার্থী জলে নামেন। অনেকে আবার জ্যান্ত পাঠাদান বা কবুতর উৎসর্গ করেন দেবদেবীর নামে। আবার অনেকে জলে নেমে পিন্ডদান ও অস্থি নিক্ষেপ করে থাকেন।

এই মেলায় আদ্য শ্রাদ্ধ করতেও আসেন অনেকে। হিন্দু মহিলারা আবার মাথা মুন্ডন করেন না। তারা জলে নেমে শাস্ত্র মতে কলার ঢাকনা দিয়ে তৈরি নৌকা ভাসিয়ে জলে ডুব দিয়ে এক ফেত্তা কাপড় মুড়িয়ে জল থেকে উঠে এসে কাপড় বদলিয়ে ব্রহ্মপুত্র স্নান সম্পন্ন করে থাকেন।

এভাবেই হিন্দু সম্প্রদায় নানা ধরণের শাস্ত্রীয় দিক পালনের মাধ্যমে ব্রহ্মপুত্র স্নান করে থাকেন। অষ্টমীর স্নানের পর অনেকে সাধু সন্ন্যাসীদের নিকট থেকে আর্শিবাদ গ্রহণ করেন। এসকল সাধু সন্ন্যাসীরা ভস্ম (চন্দন কাঠের গুড়া) গায়ে মেখে, অথবা ছাই মেখে রুদ্রাক্ষের মালা গলায় ঝুলিয়ে হাতে কপালে তীলক চিহ্ন একে ধ্যানে বসেন।

পুণ্যার্থীরা সাধু বাবার চরণে প্রণাম করে আশির্বাদ গ্রহণ করে থাকেন এবং তারা সাধু বা সন্ন্যাসীদেরকে বিনিময়ে দেন নজরানা হিসেবে টাকা পয়সা ইত্যাদি। অষ্টমীর স্নানের তারিখ আসবার এক মাস পূর্ব থেকেই এই জাতীয় সাধুদের ভীড় জমতে দেখা যায়।

এই মেলাটিকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য স্থানীয় প্রশাসন বরাবরই মেলা শুরু হবার কয়েক দিন পূর্ব থেকে বিভিন্ন রেল, নৌ এবং বাস ষ্টেশনগুলোতে দিবা রাত্রি পুলিশ টহলের ব্যবস্থা গ্রহণ করে পূণ্যার্থীদের নিরাপত্তা বিধান করেন। মেলার শান্তি শৃংখলা নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রতি বৎসর অস্থায়ীভাবে পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন করা হয়ে থাকে। পূণ্যার্থীরা যাতে বিশুদ্ধ পানি পান করতে পারে তা নিশ্চিত করবার জন্য মেলার বিভিন্ন জায়গায় টিউবওয়েল বসানো হয়ে থাকে।

বিপুল সংখ্যক পুণ্যার্থীদের থাকবার জন্য বিভিন্ন জায়গায় মেলা পরিচালনা কমিটির মাধ্যমে তাবু খাটানো হয়। এই সকল তাবুতে সারা রাত ধরে চলে একনাম জপ ও কীর্তন। স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন ঢোল, ঢাক, বাঁশি, জুরি, তবলা, হারমনিয়াম বাঁজিয়ে হরিনাম জপতে জপতে ব্রহ্মপুত্র স্নানে আসেন। ব্রহ্মপুত্র স্নানে আসা পুণ্যার্থীরা স্নান শেষে বাতাসা (ভেটি স্বরুপ) হরিলুট দিয়ে স্নানের সমাপ্তি ঘটান।

চিলমারীর অষ্টমীর মেলায় নানান জাতি, নানান রং এর সাংস্কৃতিক সমারোহ ঘটে। অষ্টমীর স্নান উপলক্ষে পুতুল নাচ, কুষাণ যাত্রা বা মেটো গান যুগ যুগ ধরে ঐতিহ্য বহন করে আসছে এখানে। পুর্বে মেলাটি হত তিন দিন ধরে। আর এখন দীর্ঘ ৫ মাইল বিস্তৃতত গরুর গাড়ীর বহর দেখা যায় না। গরুর গাড়ীর স্থান দখল করে নিয়েছে রিক্সা আর মটর বাইক, রেলগাড়ী, এখন চিলমারীর রমনা বাজার পর্যন্ত আসে। কুড়িগ্রাম থেকে চিলামারী সেই বিস্তীর্ণ মেঠো পথে বসেছে খোয়া আর পীচ। সে পথে চলে চার চাকার বাস।

আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থায় আজ চিলমারী। কিন্তু দুঃখ শুধু একটিই আর তা হলো আধুনিকতার পরশে বিলীন হয়ে যাচ্ছে লোক ঐতিহ্যমন্ডিত অষ্টমীর মেলার পুর্বের ইমেজ, দেশ বিভক্তির পর আজ চিলমারী বন্দর অবহেলিত, এলাকার হিন্দুরা চলে গেছে অধিকাংশই ভারতে। আজ যারা রয়েছে তারা অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু। তারপরও আজও মেলা হয়। আসে মানুষ।

বাংলাদেশের আর অন্য জায়গার মেলা থেকে চিলমারীর অষ্টমীর মেলা ভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ে আগামী শতাব্দীতে পা রাখবে। চিলমারীর সংগ্রামী জনতা প্রতি বছর এই দিনটিতে অসম্প্রদায়িকতার উজ্জ্বল পথিকৃৎ হয়ে প্রতীয়মান হবে সারা বাংলায়। ভুলে যাবে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র। চিলমারীর মানুষ আবার প্রমাণ করবে রাম-রহিমের সত্যিকারের চারণ ভূমি এই চিলমারী নৌ বন্দর।

যাযাদি/ এম

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে