কবি জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪) ছিলেন একজন কালসচেতন ও ইতিহাসসচেতন কবি। কবিতার উপমা প্রয়োগে জীবননান্দের নৈপুণ্য তুলনাহীন। কবিতাকে তিনি মুক্ত আঙ্গিকে উত্তীণর্ করে গদ্যের স্পন্দনযুক্ত করেন, যা-পরবতীর্ কবিদের প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছে। জীবন বোধকে নাড়া দিয়েছে।
‘বিশুদ্ধতম কবি’ বলা হয় জীবনানন্দ দাশকে। ‘রূপসী বাংলার কবি’ বা ‘পরাবাস্তবতার কবি’ও বলেন কেউ কেউ। শৈশবকালেই তার কবিতার প্রেমে পড়েছিলাম। তারপর বাংলাসাহিত্যের ছাত্র হিসাবে কবির কবিতা, সমালোচনা, প্রবন্ধ পড়তে গিয়ে আরও মুগ্ধ হই। বলা চলে, তার চমৎকার শব্দপ্রয়োগ, উপমা-উৎপ্রেক্ষা কবিতায় চমৎকার সন্নিবেশ আমাকে মুগ্ধ করে। আবহমান গ্রাম-বাংলার উপাদানগুলো তিনি নিপুণভাবে কবিতায় প্রয়োগ ঘটিয়েছেন এবং কবিতাগুলো সুখপাঠ্য করেছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি যে মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন তা বাংলাসাহিত্যে খুব কম কবিই পেরেছেন। যথাথর্তা, সাথর্কতার ক্ষেত্রে তাকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। জনপ্রিয়তায় শীষর্স্থান দখল করেছেন বিরলপ্রজ কবিতা দিয়েই। তিনি কিছু গদ্য রচনাও করেছেন। নিবন্ধের পাশাপাশি উপন্যাসও লিখেছেন ১০টি। তার কবিতার বই ১১টি। কিন্তু প্রায় অধের্ক কবিতার বই কবির মৃত্যুর পর প্রকাশ হয়েছ। নেতিবাচক এটার ক্ষেত্রেও কবি এগিয়ে। রূপসী বাংলা (১৯৫৭),বেলা অবেলা কালবেলা (১৯৬১),সুদশর্ন (১৯৭৩)-এর মতো অনন্য কবিতার সম্ভারে ভরপুর বইগুলোও কবির মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়েছে।
রবীন্দ্র-নজরুল বলয়ের বাইরে বেরিয়ে আসা বাংলাসাহিত্যের তিরিশের কবিদের পঞ্চপাÐবের মধ্যে জীবনানন্দ দাশই সবচেয়ে প্রভাবশালী ও প্রভাব বিস্তারকারী কবি হিসেবে পরিচিত লাভ করেছেন। কিন্তু তাকে সহযোগিতা করা হয়েছে খুব কমই। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তার পত্রিকায় জীবনানন্দের কবিতা ছাপাতে চেতেন না। জীবনানন্দের কবিতা নাকি তার ভালো লাগত না! তবে কয়েকটি বিষয় বাংলাসাহিত্যের ছাত্র হিসাবে বা পাঠক হিসাবে খটকা লাগে। প্রথমত-তার অনেক গ্রন্থ কেন কবির মৃত্যুর আগে প্রকাশ হয়নি! দ্বিতীয়ত বলা যায়, ট্রাম দুঘর্টনার কারণ এখনও উদঘাটিত হয়নি বা পরিষ্কার হয়নি। তৃতীয়ত, তার চাকরি থেকে অব্যাহতি বা ঘনঘন চাকরি পরিবতর্ন। অভিযোগ করা হয় কবিতায় অশ্লীলতার দায়ে তাকে অধ্যাপনার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়! না অন্য কারণ! এখনও মতপাথর্ক্য রয়েছে। কিন্তু আমি তার পক্ষে কিছু বলতে চাই। এটা আমার পযের্বক্ষণ বলা যেতে পারে বা একান্তই আমার মতামত হিসাবে বিবেচনা করতে পারেন পাঠক। তা হলো-কলকাতার সাহিত্যসমাজ বা পাঠকসমাজ কেন যেন আপন করে নিতে পারেনি! মৃত্যুর পর অবশ্য অনেকে এগিয়ে এসেছেন। তাকে যথেষ্ট মূল্যায়ন করার চেষ্টা করছেন কেউ কেউ। কিন্তু পরিমাণে অনেক কম। তার মতো প্রতিভাধর কবিতা- লেখা নিয়ে বিশেষ করে কবিতা নিয়ে আরও বিশদ আলোচনা-সমালোচনার দাবি করা যায়। বাংলাদেশে কিছু আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। কিন্তু তুলনায় অনেক কম। এখন কেউ কেউ এগিয়ে আসছেন। তিনি মূলত তার পেতে মৃত্যুর পর থেকে জনপ্রিয়তা থাকেন। এবং বতর্মানে তিনি জনপ্রিয়তম কবি।
কবির কাব্যগন্থগুলো হচ্ছে- ঝরা পালক (১৯২৭),ধূসর পাÐুলিপি (১৯৩৬), বনলতা সেন (১৯৪২), সাতটি তারার তিমির (১৯৪৮), জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৪)। নিজর্নতার কবি জীবনানদ দাশ। তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত ৫টি মৌলিক কাব্যগ্রন্থ- রূপসী বাংলা (১৯৫৭), বেলা অবেলা কালবেলা (১৯৬১), সুদশর্না (১৯৭৪), আলো পৃথিবী (১৯৮১), অপ্রকাশিত একান্ন (১৯৯৯)। এছাড়া তিনি কিছু গল্প, প্রবন্ধ, এবং ৩টি উপন্যাস লিখেছেন । যদিও তার সবকটি উপন্যাসই তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়েছে। তাই দেখা যায় যে, অপ্রকাশিত কবিতা-লেখার সংখ্যা অনেক বেশি। যা যুক্তিসংগত নয়। রূপসী বাংলা কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলোর শিল্পগুণ প্রশ্নাতীত! অন্য কবিতার ব্যাপারেও একই কথা হতে পারে। সম্ভবত জীবনানন্দের মতো অপ্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ বা কবিতা (যা পরে পাঠকসমাজকে মুগ্ধ করেছে এবং বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে) বাংলা সাহিত্যের অন্য কোনো শীষর্স্থানীয় কবির নেই। এখানেও খটকা লাগে লিখেও কেন বই আকারে সেগুলো প্রকাশ করেননি! কবির অনাগ্রহ ছিল কেন? না সাহিত্যসমাজ তাকে স্বাগত জানায়নি! প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়! সাথে তার এ অবমূল্যায়নে আমাদেরও লজ্জিত হতে হয়।
সাহিত্যের বিরল প্রতিভার অধিকারী এ কবিকে নিয়ে জীবনী প্রকাশ হয়েছে প্রায় ১৭ বছর পর। জীবনানন্দ নামে গোপালচন্দ্র রায়ের গ্রন্থটি প্রকাশ হয়। আর ১৯৯০ সালে ইংরেজি ভাষায় কবির জীবনী প্রকাশ পায়। মাকির্নী গবেষক ক্লিন্টন বুথ সিলি (ঈষরহঃড়হ ন. ঝববষু) ‘আ পোয়েট আপাটর্’ (অ চঙঊঞ অচঅজঞ) নামে। পরে অবশ্য ১৯৯৩ সালে এ বইটি কলকাতার মযার্দাপূণর্ ‘আনন্দ পুরস্কার’। বিদেশি ক্লিন্টনের বইতে কবির প্রায় পূণার্ঙ্গ জীবনী আছে। কিন্তু তার আগে কোনো বাঙালির হাতে পূণার্ঙ্গ জীবনী রচিত হয়নি। তবুও ধন্যবাদ গোপালচন্দ্র রায়কে। আন্তরিক চেষ্টা করার জন্য। এসব ঘটনায় প্রমাণিত হয় বাঙালি সাহিত্যসমাজ কবিকে যথাথর্ মূল্যায়ন করতে পারেনি।
১৯৩২ সালে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সম্পাদিত ‘পরিচয়’ পত্রিকায় ‘ক্যাম্পে’ নামক কবিতা প্রকাশিত হয়। কবিতার কিছু অংশ তুলে ধরছি-
‘একে একে হরিণেরা আসিতেছে গভীর বনের পথ ছেড়ে।
সকল জলের শব্দ পিছে ফেলে অন্য এক আশ্বাসের খেঁাজে
দঁাতের-নখের কথা ভুলে গিয়ে তাদের বোনের কাছে ওই
সুন্দরী গাছের নিচে জ্যোৎস্নায়!
মানুষ যেমন করে ঘ্রাণ পেয়ে আসে
তার নোনা মেয়ে মানুষের কাছে।...’
এ কবিতায় অশ্লীলতার অভিযোগে সিটি কলেজের অধ্যাপনা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয় বলে অভিযোগ করা হয়। সজনীকান্ত আজীবন নেতিবাচক সমালোচনা করতেন। কলকাতার অনেকে জীবনানন্দের সমালোচনায় মুখর ছিলেন। সেজন্য বিতকের্র জায়গা না থাকলেও বিতকর্ করার চেষ্টা করেছেন। না হলে প্রকাশিত কবিতায় ‘নোনা মেয়ে’ শব্দ নিয়ে কেন এত বিতকর্! আলোচ্য কবিতায় কোথায় অশ্লীলতা রয়েছে! এ মত অনেকের। এ থেকে ধারণা করা হয় প্রথমে কলকাতার সাহিত্যসমাজ কবিকে মেনে নিতে পারেননি! মৃত্যুর পর বতর্মান প্রজন্ম তাকে মূল্যায়িত করার চেষ্টা করছেন। বলা যায়, কবির কবিতার অনুপম শিল্পগুণ পাঠকসমাজকে আকৃষ্ট করছে।
ক্যাম্পে কবিতার বিরুদ্ধে অশ্লীলতার সবচেয়ে বড় অহেতুক অভিযোগটা করেন সজনীকান্ত সেন তার ‘শনিবারের চিঠি’ পত্রিকায়। সজনীকান্ত জীবনানন্দকে পছন্দ করতেন জীবনানন্দ দাশের কবিতা কোথাও প্রকাশিত হলেই তিনি সেটাকে নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রæপ করতেন, হাসি-ঠাট্টা তামাশা করতেন। তাকে মাতাল, পাগল ইত্যাদি নানা অভিধায় ভ‚ষিত করতেন বলে অনেকে বলে থাকেন। ‘ক্যাম্পে’ কবিতাটা পরিচয়ে ছাপা হওয়ার পরে তিনি তার শনিবারের চিঠিতে এই কবিতার বিষয়ে লিখলেন, ‘কবিতাচ্ছলে কবি যে বিরহিণী ঘাইহরিণীর আত্মকথা ও তাহার হৃদতুতো দা’র মমর্কথা কহিয়াছেন তাহা পরম রমণীয় হইয়াছে। বনের যাবতীয় ঘাইহরিণকে তাহাদের হৃদয়ের বোন ‘ঘাইহরিণী’ অঘ্রাণ ও আস্বাদের দ্বারা তাহার পিপাসার সান্ত¡নার জন্য ডাকিতেছে। পিসতুতো, মাসতুতো ভাইবোনদের আমরা চিনি। হৃদতুতো বোনের সাক্ষাৎ এই প্রথম পাইলাম।’
১৯৫৪ সালের ১৪ অক্টোবর। প্রতি দিনের মতো ল্যান্সডাউন রোডের বাড়ি থেকে বিকেলে হঁাটতে বেরিয়েছিলেন। বিকেলে হঁাটতে বেরিয়ে আর বাড়ি ফেরেননি জীবনানন্দ। শহরের ট্রামলাইনে তার পথ চলা থেমে গিয়েছিল। শহরের প্রাণঘাতী ট্রামলাইনে তার পথ হঁাটা থেমেছিল। তবে আবহমানের শব্দস্রোত থামেনি! কিন্তু ট্রাম দুঘর্টনার আসল কারণ এখনও উদ্ধার হয়নি। ঘাতক ট্রামটি পরে আগুনে ভস্মীভ‚ত হয়েছে বলে জানা যায়।
লেনদেন সেরে সব পাখি, নদী ঘরে ফিরে আসে। কবি জীবনানন্দ আর ফিরে আসবেন না। কিন্তু কবি জীবনানন্দের শব্দ থামবে না। গ্রামবাংলার আবহমানের সব উপাদান, অবিশ্বাস্য সব শব্দ ও তাদের বুনন, উপমা-চিত্রকল্পের অনুপম নিদশর্ন তাকে আধুনিক কবিতায় শীষর্স্থানে নিয়ে গেছে। এপার-ওপার, দুই বাংলায় কবির স্থান পাঠকসমাজে বা সমালোচনায় উত্তীণর্ হয়ে স্থায়ী আসন গড়ে নিয়েছে মৃত্যুর পরপরই। কবির ‘সহজ’ কবিতার কিছু অংশ দিয়েই শেষ করি-
‘আমার এ গান
কোনোদিন শুনিবে না তুমি এসেÑ
আজ রাত্রে আমার আহŸান
ভেসে যাবে পথের বাতাসেÑ
তবুও হৃদয়ে গান আসে!
ডাকিবার ভাষা
তবুও ভুলি না আমিÑ
তবু ভালোবাসা
জেগে থাকে প্রাণে!’(সংক্ষেপিত,ধূসর পাÐুলিপি কাব্যগ্রন্থ থেকে)