শিশুর প্রতি নির্মমতার হার দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে সারা দেশে সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে ২ হাজার ১৫৮ শিশু। এর মধ্যে নির্মমতার শিকার হয়ে মারা গেছে ৯৮৮ শিশু। গত বছরের প্রথম ৬ মাসের তুলনায় এ বছরের প্রথম ৬ মাসে শিশু ধর্ষণের হার বেড়েছে ৪১ শতাংশ। শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করা জাতীয় নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের (বিএসএএফ) পরিসংখ্যানে এমন তথ্য উঠে এসেছে। আমরা মনে করি এই তথ্য নিঃসন্দেহে ভয়াবহ। এই পরিসংখ্যান দ্বারা এটাই প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়, সমাজে আমরা আমাদের কোমলমতি শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারিনি। এটা আমাদের জাতীয় ব্যর্থতা।
মানুষ কতটা বর্বর হলে শিশুদের নির্যাতন ধর্ষণ ও হত্যা করতে পারে তা আমাদের মাথায় ধরে না। এটা সামাজিক অবক্ষয়ের চূড়ান্ত নজির। ইদানীং মানুষের লোভ, আক্রোশ, নিষ্ঠুরতা ও জিঘাংসা অতিমাত্রায় বেড়ে গেছে। যার নিষ্ঠুর শিকার হচ্ছে কোমলমতি শিশুরা। বেশির ভাগ সময়ে তাদের অপহরণের পর খুন করা হচ্ছে কিংবা পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। অভাব, হাহাকার, হতাশায় বাবা-মাও নিজের সন্তানকে হত্যা করছেন অবলীলায়। এ ছাড়া সামান্য অপরাধে শিশুকে অমানুষিক নির্যাতন করা হচ্ছে। শিশুর প্রতি এমন নির্দয় আচরণ কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। এটা অবক্ষয়গ্রস্ত সমাজেরই এক ভয়াবহ করুণ চিত্র। এই চিত্র বদলানো জরুরি। এটা সম্ভব না হলে আমাদের শিশুরা থাকবে নিরাপত্তাহীন।
অবাক ব্যাপার যে, দেশে শিশু নির্যাতনের পাশাপাশি নারীর প্রতি যৌন নির্যাতনও বেড়ে গেছে। নির্যাতন করছে কলেজ শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ডাক্তার, কর্মচারী, পুলিশ, আত্মীয়, চাচা-মামা-খালু, দুলাভাই, আমলা, ধনীর দুলাল। কেউ বাদ যাচ্ছে না। ধর্ষিত হচ্ছে ছাত্রী, যুবতী, আয়া, বুয়া, গৃহবধূ। রাস্তা-ঘাটে, রেস্তোরাঁয়, চলন্ত বাসে, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে, গৃহে ঘটছে এই পৈচাশিক ঘটনা। কোথাও আজ নারীরা নিরাপদ নয়। আমাদের নারী, শিশুরা যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে না, এমনকি ধর্ষনের পর খুন হচ্ছে।
এখানে বিশেষভাবে উলেস্নখ্য, সিলেটের চাঞ্চল্যকর শিশু রাজন হত্যা ও খুলনায় রাকিবকে নৃশংস নির্যাতনের মধ্যদিয়ে শিশুহত্যার ঘটনায় সারা দেশে ব্যাপক তোলপাড় হয়। নির্যাতনের ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার হওয়ায় দেশের বিভিন্ন এলাকায় এ ঘটনায় দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির প্রতিবাদে মিছিল-সমাবেশ হয়। এরপর থেকে সারা দেশের শিশু নির্যাতনের ঘটনা সামনে আসতে থাকে। শিশু অধিকার সংরক্ষণ করা এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। শিশুর সঠিকভাবে বেড়ে ওঠা, তার বিকাশের ক্ষেত্রেও সমাজ ও রাষ্ট্রীয় উদাসীনতা একেবারে কম নয়।
দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, অপার সম্ভাবনা ও স্বপ্ন নিয়ে যে শিশুর নিরাপদে বেড়ে ওঠার কথা সে কেন অপহরণ ধর্ষণ ও নিষ্ঠুর হত্যার শিকার হবে? এর জন্য কি কেবল ব্যক্তি দায়ী? শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সমাজ ও রাষ্ট্রের কি কোনো ভূমিকা নেই? আমরা অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিসহ এই ধরনের ঘটনার দ্রম্নত অবসান চাই। মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধ ও সামাজিক সুস্থতার জন্যও বিষয়টি জরুরি এবং এর কোনো বিকল্প নেই।