শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কতটা শক্তিশালী?

মো. আশিকুর রহমান ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
  ১৪ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০

বর্তমান বিশ্বায়নের এই যুগে বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বেশি আলোড়ন সৃষ্টি করেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কি খাম-খেয়ালি নাকি শিল্প বিপস্নবের পরে বিশ্বব্যাপী সব থেকে বড় পরিবর্তন সাধন করেছে? সর্বস্তরের মানুষ এখন এগুলোর মধ্যে তাদের জীবনের বড় একটা অংশ অতিবাহিত করছে। তাদের আবেগ-অনুভূতি, মতামত বা বন্ধুত্ব সবকিছু এটিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে। অনেকে এটিকে পুঁজি করে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করছে এবং প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে সহজেই প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে সমাজে। শুধু কি তাই, বিশ্বের ইতিহাস পরিবর্তনের নেপথ্যে এটি উলেস্নখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। যার উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত হচ্ছে 'আরব বসন্ত'। তিউনিসিয়ার সিদি বওজিদ শহরে বেকার কম্পিউটার গ্র্যাজুয়েট বোউয়াজিজির আত্মহননের মধ্যদিয়ে অন্যায়, অত্যাচারের যে প্রতিবাদ তিনি করেছিলেন, তা পরিণত হয়েছিল 'আরব বসন্ত'-এ। অগ্নিদগ্ধ বোউয়াজিজির আত্মত্যাগ ও তিউনিসিয়ার প্রশাসনিক দুর্বৃত্তায়নের ফলে দেশটির প্রায় ৩০ শতাংশ বেকার যুবক বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। রাজপথের আন্দোলনে স্বৈরশাসকদের ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীর লাঠ্যমৃত প্রয়োগ করলে বিতাড়িত তরুণ প্রজন্ম ঠাঁই নেয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ফেসবুক, টুইটার, বস্নগ, ইউটিউব, মাইস্পেস থেকে শুরু করে নানা মাধ্যমে নতুন করে ভাষা পায় তারুণ্যের প্রতিবাদে। কিন্তু সামাজিক মিডিয়া বা স্যাটেলাইট চ্যানেলের মাধ্যমে সরকারবিরোধী মতামত যেন তৈরি না হয় সেটি নিশ্চিত করতে শাসকরাও চুপচাপ বসে ছিল না। তিউনিসিয়ার সরকার সাইবার ক্যাফে নিয়ন্ত্রণ, সামাজিক যোগাযোগ ও ওয়েবসাইট নজরদারি ও প্রয়োজনে বন্ধ করে দেয়ার নীতি গ্রহণ করে। একই ধরনের পদক্ষেপ নেয় মিশর সরকারও। টুইটার ও ফেসবুক বন্ধ করে দেয়ার পরেও বিভিন্ন প্রক্সি সার্ভার ব্যবহার করে আইপি পরিবর্তন করে তরুণ প্রজন্ম তাদের প্রচারণা চালাতে থাকে। ফলে ভিডিও ও আলোকচিত্রের মাধ্যমে একের পর এক বিশ্ববাসীর সামনে উন্মোচিত হতে থাকে স্বৈরতান্ত্রিক শাসকের নানা ধরনের অপকর্ম এবং নিষ্ঠুরতা। গণআন্দোলনের মুখে ক্ষমতা থেকে সরে আসতে বাধ্য হন স্বৈরশাসক জয়নাল আবেদিন বেন আলী। সেই প্রতিবাদের ঢেউ ছড়িয়ে গিয়েছিল তিউনিসিয়া থেকে মিশরে, ইয়েমেনে এবং লিবিয়ায়। একের পর এক পতন ঘটেছিল স্বৈরাচারী সরকারের। যার নেপথ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছিল। তা ছাড়া উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্য ছাড়িয়ে প্রতিবেশী দক্ষিণ ককেসাস অঞ্চলের আর্মেনিয়া, জর্জিয়া, আজারবাইজান, ইউরোপের আলবেনিয়া, স্পেন, ক্রোয়েশিয়া, সাব সাহারান অঞ্চলের বারকিনা ফাসো, জিবুতি, উগান্ডা এবং মালদ্বীপ ও চীনেও আরব বসন্তের প্রভাবে সামাজিক মিডিয়া ব্যবহার করে আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল। এসব দেশের তরুণ আন্দোলনকারীরা তাদের চিন্তা, ধারণা, কৌশল পরস্পরের সঙ্গে লেনদেন করেছে, একে অন্যের নীতিগত সমর্থন দিয়েছে। এর ফলে দেশগুলোতে মিথ্যা ও দুর্নীতিকে উন্মোচিত করে ভীতির দেয়ালকে ভেঙে ফেলতে সহায়তা করেছিল। সুতরাং এ দ্বারা বোধগম্য হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বৈশ্বিক ক্ষমতা পরিবর্তনে সামর্থ্য আছে। বাংলাদেশে 'কোটা সংস্কার আন্দোলন' ও 'নিরাপদ সড়ক আন্দোলন' সফল হওয়ার পিছনেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ইতিহাস পরিবর্তনের পাশাপাশি ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাব ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত। এর মাধ্যমে বিশ্বের এক প্রান্তের মানুষ অন্যপ্রান্তে সহজে যোগাযোগ ও ভাব-বিনিময় করতে পারে। এটি পুরা বিশ্বকে একটি ডিজিটাল বৈশ্বিক গ্রামে (গেস্নাবাল ভিলেজ) পরিণত করেছে। বাংলাদেশের ৩২ মিলিয়ন মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করছে। যার অধিকাংশই হচ্ছে তরুণ প্রজন্ম। (সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে কাজ করা বৈশ্বিক সংগঠন হটসুইটের তথ্য মতে)। যদি ফেসবুক একটা দেশ হতো তাহলে জনসংখ্যার হিসেবে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম দেশ হতো। কিন্তু আমরা যদি মুদ্রার অন্য পিঠের কথা চিন্তা করি তাহলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ? আসলে এটি আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ এটি সম্পূর্ণ নির্ভর করে ব্যবহারকারীর মনস্তাত্ত্বিক বিষয়ের ওপর। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারে সচেতনতা অবলম্বন করলেও বাংলাদেশে সেটির অবস্থা অত্যন্ত যৎসামান্য। যেমন- তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান বলেছেন, 'সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সমাজের সবচেয়ে দুরারোগ্য ব্যাধি'। এজন্য তুরস্কে ইউটিউব, ফেসবুক এবং টুইটার নিষিদ্ধ। এ ছাড়া পশ্চিমা দেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এগুলো খুবই শক্ত হাতে মনিটরিং করা হয় এবং নিরাপত্তার ওপর অধিক জোর দেয়া হয়। কিন্তু আমরা তা অনেকাংশই ব্যর্থ হয়েছি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে পর্নোগ্রাফি ওয়েব দুনিয়ার এক নম্বর আগ্রহের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেটি আমাদের নৈতিকতা অবক্ষয় হওয়ার পাশাপাশি সামাজিক জীবনে এর কুফল মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। একবিংশ শতাব্দীতে এসে যেন সামাজিকতার ধরনই বদলে যাচ্ছে এসব যোগাযোগ ব্যবস্থার বদৌলতে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ক্রমেই আমাদের মনে রাখার ক্ষমতা কমিয়ে দেয়ার পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন রকমের সমস্যা তৈরি করছে। এ ছাড়া নিরাপত্তাহীন তথ্য সংরক্ষণ বা ভিত্তিহীন- ভুয়া খবর প্রচারের মাধ্যমে জনসাধারণের বিভ্রান্তি ও প্রশাসনিক বিপর্যয়ও দেখা দিচ্ছে। তা ছাড়া অতিরিক্ত আসক্তির ফলে ব্যক্তিত্ব বিকাশের পথ রুদ্ধ হচ্ছে এবং কমে যাচ্ছে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা। যখন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বড় হওয়ার চিন্তা করার কথা, তখন তারা চিন্তা করছে- ফেসবুকসহ অন্যান্য যোগাযোগ ব্যবস্থায় নিজেকে কীভাবে সেরা দেখানো যায়। আমাদের মনে রাখতে হবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো জীবন নয়, জীবনের অতি একটা ক্ষুদ্র অংশ। সুতরাং ব্যক্তি, রাষ্ট্র ও বৈশ্বিক জীবনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর যথাযথ সুফল বয়ে আনার জন্য সর্বস্তরের মানুষের আরও বেশি সচেতন হওয়ার কোনো বিকল্প নেই।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<75357 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1