রোববার, ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

বিমা নিয়ে আস্থার সঙ্কট, পলিসি শেষ হলেও সময়মতো টাকা মেলে না

যাযাদি ডেস্ক
  ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১১:৫৮
পিরোজপুরের নাজমুল হোসেন

পিরোজপুরের নাজমুল হোসেন বাবাকে নিয়ে এসেছেন ঢাকার মতিঝিলে। উদ্দেশ্য একটি বিমা কোম্পানির হেড অফিসে গিয়ে বিমার টাকা উদ্ধার করা। তার পরিবারে দু’টি পলিসির মেয়াদ শেষ হওযার পর এ টাকার পেছনে ঘুরছেন প্রায় দুই বছর ধরে।

নাজমুল হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলছেন, পলিসির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর যখন তারা টাকা তুলে নিতে চান, তখন স্থানীয় বিমা কোম্পানির অফিস থেকে চাপ দেয়া হয় টাকাটা একই কোম্পানিতে ডিপিএস করে রাখতে।

‘কিন্তু আমরা ডিপিএস করতে চাই নাই। আমরা টাকা চেয়েছিলাম। পরে হঠাৎ একদিন শুনি আমাদের অনুমিতি ছাড়াই তারা ডিপিএস করে ফেলেছে। আমরা যখন এর প্রতিবাদ করি এবং হেড অফিসে জানাই তখন বলা হয় যে, টাকা ফেরত দেবে।

‘কিন্তু ২০ শতাংশ টাকা কেটে রাখবে। কারণ আমরা ডিপিএস ভেঙে ফেলছি। কিন্তু যে ডিপিএস আমরা করি নাই, সেটার জন্য কেন আমরা ২০ শতাংশ টাকা জরিমানা দেবো?’ প্রশ্ন তোলেন নাজমুল হোসেন।

তিনি জানাচ্ছেন, বেশ কিছুদিন ঘোরাঘুরির পর তাদের জানানো হয়, টাকা ফেরত দেয়া হবে। কিন্তু সেটা আর হচ্ছে না।

‘কখনো বলে আগামী মাসে আসেন, কখনো বলে চেক হয় নাই। কখনো বলে উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নাই। একেকবার একেক কথা। শুধু হয়রানি। কাজ আর হচ্ছে না।’

বিমা নিয়ে আস্থার সঙ্কট বিমা নিয়ে নাজমুল হাসানের যে অভিজ্ঞতা সেটা নতুন নয়। খোদ বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের ২০২০ সালের সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে, বিমা কোম্পানিগুলোতে এখনো অনেক বিমা দাবি মেয়াদ শেষে নিস্পত্তি হচ্ছে না, অর্থাৎ গ্রাহক টাকা বুঝে পাচ্ছেন না।

জীবন বিমার ক্ষেত্রে দাবি নিষ্পত্তির হার ৬৭ শতাংশ। আর সাধারণ বিমার ক্ষেত্রে ৩৫ শতাংশ।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে বিমার কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৭৩ সাল থেকে। এখনো পর্যন্ত বিমা কোম্পানি কাজ করছে ৮১টি। কিন্তু ৫০ বছরের বেশি সময় পার হলেও বাংলাদেশের বিমা খাত সেভাবে বিস্তৃত হয়নি। সরকারি হিসেবে বিমার আওতায় আছেন মাত্র এক কোটি ৮০ লাখ মানুষ।

উন্নত বিশ্বে ব্যক্তির হঠাৎ মৃত্যু কিংবা দুর্ঘটনাজনিত আর্থিক ক্ষতি কমাতে জীবন বিমা প্রচলিত একটা মাধ্যম। বিশেষ করে স্বাস্থ্যখাতে ব্যক্তির ব্যয়ের বোঝা কমাতে স্বাস্থ্যবিমা অনেক দেশেই ব্যাপক প্রচলিত।

কিন্তু বাংলাদেশে দীর্ঘদিন চেষ্টার পরও বিমা খাত সেভাবে দাঁড়াতে পারেনি।

সপ্তাখানেক আগে বেসরারি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স বিভাগ থেকে বিমা খাতের ওপর এক গবেষণায় ওঠে এসেছে বিমাখাত নিয়ে সাধারণ মানুষের আস্থাহীনতার কথা।

যার মূল কারণ মেয়াদ শেষে বিমার টাকা যথাসময়ে ফেরত না পাওয়া কিংবা প্রতারণার শিকার হওয়া।

কিন্তু বিমা খাতে এমন দীর্ঘ প্রতারণার ইতিহাস এবং এর কারণে আস্থাহীনতা কমাতে বিমা কোম্পানি কিংবা এর নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ কী করছে? বাংলাদেশের বিমা খাত কি আদৌ ঘুরে দাঁড়াতে পারবে?

উন্নত বিশ্বে ব্যক্তির হঠাৎ মৃত্যু কিংবা দুর্ঘটনাজনিত আর্থিক ক্ষতি কমাতে জীবন বিমা বেশ প্রচলিত একটা মাধ্যম। তবে বাংলাদেশে এটি সেভাবে জনপ্রিয় নয়।

গবেষণা কী বলছে? বাংলাদেশে বিমা খাত নিয়ে চলতি ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে একটি গবেষণা প্রকাশ করে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স বিভাগ।

সেই গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছেন বিভাগটির ডিন মো: নুরুল কবীর। তাদের গবেষণাতেও বাংলাদেশে বিমা খাতের বিস্তার না হওয়ার পেছনে মূল কারণ হিসেবে উঠে এসেছে আস্থাহীনতার কথা। আর এই আস্থাহীনতার মূল কারণ পাওনা দাবি নিষ্পত্তিতে জটিলতা।

নুরুল কবীর বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘গবেষণায় মানুষ যেটা বলেছে যে আমরা ইন্সুরেন্স কন্টিনিউ করছি, কিন্তু যখনই আমার প্রয়োজনটা দেখা দিচ্ছে অর্থাৎ কোনো দুর্ঘটনা ঘটছে, তখন আমরা কোম্পানির কাছে যাচ্ছি। কিন্তু টাকাটা আমি পাচ্ছি না। এখান থেকে ওখানে ঘুরাচ্ছে। তাহলে যে ঝুঁকিটা মেটানোর জন্য আমি ইন্সুরেন্সটা করলাম, আমার তো সে উদ্দেশ্য পূরণ হলো না। তখনই হচ্ছে, মানুষের কাছে নেগেটিভ ইম্পেশনটা অনেক বেশি ছড়িয়ে যায়।’

বাংলাদেশে এখনো পর্যন্ত বিমা কোম্পানি গড়ে উঠেছে ৮১টি। কিন্তু বিশ্বব্যাপী বিমা ব্যবসা নিয়ে যে র‍্যাঙ্কিং সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৫তম।

এছাড়া বিমা খাতে মোট সম্পদের যে প্রবৃদ্ধি সেটা যেমন কমছে, তেমনি প্রিমিয়াম আয়ের ক্ষেত্রেও সেভাবে অগ্রগতি নেই।

ফলে মৃত্যু, দুর্ঘটনা, অঙ্গহানিসহ এ ধরণের ঘটনায় বিমা না করায় আর্থিক সুবিধার বাইরেই থাকছেন অধিকাংশ মানুষ। এছাড়া স্বাস্থ্যবিমার প্রসার না ঘটায় চিকিৎসাখাতেও মানুষের ব্যক্তিগত ব্যয় বাড়ছে।

সর্বশেষ সরকারি হিসেবে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে একজন মানুষের চিকিৎসার পেছনে যে ব্যয় হয়, তার ৬৯ শতাংশই যায় ব্যক্তির পকেট থেকে।

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মো: নুরুল কবীর বলছেন, মানুষ স্বাস্থ্যবিমার আওতায় থাকলে সেটা তার চিকিৎসা খরচের বোঝা কমাতে সাহায্য করতো। কিন্তু মানুষের মধ্যে সে বিষয়ে আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না।

এছাড়া বিমা করলে কী উপকার হবে, বিমা পলিসি কখন, কী কারণে বাতিল হবে, এটা যে সাধারণ ব্যাংকে টাকা জমানোর মতো সিস্টেম না- সেসব বিষয়ে কোম্পানির অ্যাজেন্টরা অনেক ক্ষেত্রেই পূর্ণাঙ্গ তথ্য দেন না গ্রাহকদের।

‘বিমার পলিসিগুলো সাজানো-গোছানো। কিন্তু যেভাবে এটা বর্ণনা করা হয়, সেটা বোঝাটা সাধারণ মানুষের জন্য কঠিন। অ্যাজেন্টরাও এক্ষেত্রে সব তথ্য দেয় না।’

‘যেমন- এটা খুব কমই অ্যাজেন্টরা বলে যে যদি কোনো পলিসি ম্যাচিউরড বা মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই আপনি বন্ধ করেন, তাহলে আপনি জরিমানার মধ্যে পড়তে পারেন বা আপনি পুরো টাকা ফেরত নাও পেতে পারেন। এখানে ডিপিএসের মতো ফুল পেমেন্ট পাবেন না। কিন্তু এসব তথ্য গ্রাহকদের বলা হয় না।’

পলিসি বাতিল হলে লাভ কার? বাংলাদেশের বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের হিসেব অনুযায়ী, ২০২২ সালে নতুন ১৭ লাখ ৭১ হাজার পলিসি চালু হয়েছে বিমা খাতে। কিন্তু এর বিপরীতে পলিসি বাতিল হয়েছে ১১ লাখ ৫০ হাজার।

নির্ধারিত সময়ের আগে পলিসি বাতিল হলে সেই টাকা কোম্পানি পেয়ে যায়। ফলে কোম্পানিগুলোও বাতিল হওয়া ঠেকাতে সেভাবে উদ্যোগী হয় না বলে অভিযোগ। এ কারণে বাংলাদেশে বেশ বড় সংখ্যায় পলিসি বাতিল হচ্ছে প্রতিবছর।

জানতে চাইলে বিমা কোম্পানিগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ইন্সুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট শেখ কবির হোসেন স্বীকার করছেন, এটা ঘটছে।

তার ভাষায়, ‘পলিসি নির্দিষ্ট একটা সময়ের আগে বাতিল হলে, সেই টাকাটা কিছু অ্যাজেন্ট পায়, বাকিটা কোম্পানি খায়।’

কিন্তু বিমা খাতে এমন অবস্থার বিপরীতে প্রতারণা এড়ানো এবং খাতকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলো কী করছে?

‘কোম্পানিগুলোকে আমরা বলতে পারি, বলি। কিন্তু সেটা তো তারা শুনবে না। আমরা বলেছি যে নন-লাইফ ইন্সুরেন্সে ২৫ শতাংশের বেশি কমিশন দেয়া যাবে না। কিন্তু দেখা যায় যে, অনেকে তার চেয়ে বেশি দিয়ে দেয়। তারপর দুই নম্বরি করে। লাইফ-ইন্সুরেন্সের টাকা ব্যাড-ইনভেস্টমেন্ট করে ফেলে।’

‘এখানে আমাদের করণীয় কিছু নাই। যারা রেগুলেটরি অথরিটি তাকে শক্ত হতে হবে। এমন প্রক্রিয়া করতে হবে যেন কোম্পানিগুলো এভাবে টাকা নিতে না পারে,’ বলছিলেন কবির হোসেন।

তার মতে, বাংলাদেশে বিমা খাতে যে প্রতারণা সেটা সব কোম্পানি করছে না। এটার দায়ভার গুটিকয়েক কোম্পানির।

কর্তৃপক্ষ কী করছে? বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিমা খাত দীর্ঘদিন চললেও এই খাতে কার্যকর নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান এবং আইন তৈরি হয় ২০১০ সালের পরে। আর জাতীয় বিমা নীতি এসেছে ২০২৩ সালে।

এতোদিন বিমা খাতে প্রতারণা এবং দুর্নীতি চললেও সেটা যে কার্যকরভাবে ঠেকানো যায়নি তার বড় কারণ কার্যকর কোনো আইনি এবং প্রাতিষ্ঠানি কাঠামো না থাকা।

২০১০ সালের পর সেটা শুরু হলেও আইন এবং প্রতিষ্ঠান গোছাতেই শেষ হয়ে গেছে এক যুগেরও বেশি সময়।

জানতে চাইলে বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জয়নুল বারী বলেন, যেসব কোম্পানি প্রতারণা করেছে কিংবা করছে তাদের পার পাওয়ার সুযোগ নেই।

‘এখানে ১৯টা কোম্পনি আছে, যাদের বিমা দাবি পরিশোধের হার কিন্তু ৮২ শতাংশ থেকে ৯৯ শতাংশ পর্যন্ত। কিন্তু হ্যাঁ, কিছু কোম্পানি আছে যারা খারাপ করছে। তাদের সংখ্যা বেশি নয়। তাদের দাবি পরিশোধের হার খুবই কম,’ বলেন জয়নুল বারী।

তিনি বলেন, এর কারণ হলো দীর্ঘদিনের অনিয়মের ফলে এসব কোম্পানি তাদের আর্থিক সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে।

‘আমরা অনেকগুলো কোম্পানি যাদের স্থাবর সম্পত্তি ছিল, সেগুলো বিক্রি করে গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছি এবং সেটা পর্যায়ক্রমে তারা করছে।’

জয়নুল বারী জানাচ্ছেন, ইতোমধ্যেই কোনো কোনো কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ স্থগিত করা হয়েছে, শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এতে কাজ হচ্ছে। তাদের মূল লক্ষ্য, আগের অনিয়মের প্রতিকার এবং সামনে যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেটা নিশ্চিত করা।

’প্রতারণা রোধে সারা পৃথিবীতে যে ধরণের রেগুলেটরি ফ্রেমওয়ার্ক থাকে, টুলস থাকে সেগুলো আমরা চালু করছি। আমরা কোম্পানিগুলোর রিস্ক প্রফোইল চালু করব। গ্রাহকদের টাকা তারা কোথায়, কিভাবে বিনিয়োগ করবেন সেগুলো দেখা হচ্ছে।’

কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছে, বিমা কার্যক্রমে ভবিষ্যতে দুর্নীতি এড়াতে আরো দু’টি জিনিস করা হচ্ছে।

১. সব কোম্পানির জন্যই বিমার টাকা জমা দেয়ার প্রক্রিয়াকে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার অধীনে আনা যেন টাকা জমার তথ্য তাৎক্ষণিক পাওয়া যায়। এখনো অনেক কোম্পানি এর আওতায় নেই।

২. পলিসি বিক্রয়ের জন্য বিমাখাতের সাথে ব্যাংক ব্যবস্থাকে সংযুক্ত করা। অর্থাৎ ব্যাংক থেকেই বিমার জন্য নতুন গ্রাহক খোঁজা হবে। ব্যাংক এতে অনেকটা বিমা কোম্পানির অ্যাজেন্টের ভূমিকায় থাকবে। এতে করে অ্যাজেন্টদের কমিশন ব্যাংক পাবে। অন্যদিকে পলিসি এবং টাকা জমাসহ সবকিছু ব্যাংকিং সিস্টেমে থাকায় প্রতারণা বন্ধ হবে।

সরকার আশা করছে, নতুন আইন ও নীতিমালার প্রয়োগে আস্থা ফিরবে এই খাতে। তবে সেটা কতটা হবে তা নির্ভর করছে কোম্পানিগুলোর কার্যক্রমে স্বচ্ছতা কতটা ফিরে আসবে এবং মানুষ কিভাবে উপকার পাবে তার ওপর। সূত্র : বিবিসি

যাযাদি/ এস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে