রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১
ভারতের তিন রাজ্যে ভোটে জয়

আত্মবিশ্বাস বেড়েছে গেরুয়া শিবিরের

যাযাদি ডেস্ক
  ০৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০
ভোটের ফল প্রকাশের পর জয়পুরে উচ্ছ্বাস বিজেপি সমর্থকদের

'মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়' (মোদি থাকলে সবই সম্ভব)- ২০১৯ সালে ভারতের লোকসভা নির্বাচনের আগে এটাই ছিল গেরুয়া শিবিরের স্স্নোগান। চলতি বছরের মে মাসে কর্ণাটকে এবং গত বছরের শেষ নাগাদ হিমাচল প্রদেশে ভরাডুবির পর ভারতের পাঁচ রাজ্যে সদ্য অনুষ্ঠিত বিধানসভা নির্বাচনে তিনটি হিন্দিভাষী রাজ্যেই বিজেপির জয়ের কৃতিত্বও তাদের নেতা নরেন্দ্র মোদির ঝুলিতেই দিচ্ছে দলটি। মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান এবং ছত্তিশগড়- এই তিন রাজ্যের মধ্যে প্রথমটি ছাড়া বাকি দুটিতেই আবার কংগ্রেসকে হটিয়ে সরকার গঠন করছে তারা। ভারতে ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আর কয়েক মাস বাকি থাকতে 'সেমিফাইনালে' এই জয় গেরুয়া শিবিরের আত্মবিশ্বাস দৃঢ় করেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো- 'সেমিফাইনালের এই ট্রেন্ড' আসন্ন লোকসভা ভোটেও বজায় থাকবে কি?

সেমিফাইনালে ৩-১

বিধানসভা ভোটে তেলেঙ্গানায় গেরুয়া শিবিরে তাদের পদ্ম ফোটাতে না পারলেও 'হিন্দি বেল্টে' বিপুল জয় হয়েছে বিজেপির। মধ্যপ্রদেশে ২৩০টির মধ্যে বিজেপি জিতেছে ১৬৩টি, কংগ্রেস ৬৬। অন্যদিকে, ছত্তিশগঢ়ে ৯০টি আসনের মধ্যে বিজেপির দখলে ৫৪টি। দুটি আসনেই গতবারের তুলনায় বিজেপির ভোট কিছুটা বেড়েছে। রাজস্থানের ১৯৯টি আসনের মধ্যে ১১৫টি বিজেপির দখলে আর কংগ্রেস পেয়েছে ৬৯টি আসন। তেলেঙ্গানায় ১১৯টি আসনের ৬৫টি কংগ্রেসের ঝুলিতে। সেখানে কংগ্রেসের ভোট যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে বিজেপির ভোটও। মোটের ওপর বিশ্লেষকদের মতে, লোকসভা ভোটের আগে, 'সেমিফাইনালে' বিজেপির ৩-১ এর এই জয় বেশ তাৎপর্যপূর্ণ।

কারণ, এরই মধ্যে একাধিক বিরোধীদের প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে দলটিকে। মোদি-আদানি সম্পর্ক, ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থা, মূল্যবৃদ্ধি, সীমান্তে চীনের অনুপ্রবেশ, একাধিক বিষয় নিয়ে রাজ্যগুলোর সঙ্গে কেন্দ্রের বিবাদের মতো বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিরোধীরা সরব থেকেছে। এসবের মধ্যেই এই জয়কে মোদি নিজেই 'ঐতিহাসিক' বলে আখ্যা দিয়েছিলেন।

হ্যাটট্রিকের গ্যারান্টি

এর আগে হিমাচল প্রদেশ ও কর্ণাটকের নির্বাচনে বিজেপি ভালো ফল না করতে পারায় বিরোধী দলগুলোর যে আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়েছিল, এই তিনটি জয়ের পর সেই বিশ্বাসে চিড় ধরেছে বলেই মনে করছেন ক্ষমতাসীনরা। সেই বিশ্বাস থেকেই মোদি 'হ্যাটট্রিক'-এর 'গ্যারান্টি' দিয়েছেন। ফল ঘোষণার পর তিনি বলেছিলেন, 'আজকের হ্যাটট্রিক ২০২৪-এর হ্যাটট্রিক-এর গ্যারান্টি দিয়ে দিয়েছে।'

সাম্প্রতিক নির্বাচনের ফলের নিরিখে দেখতে পাওয়া তথাকথিত 'মোদি ম্যাজিক' রেশ কাটার আগেই ২০২৪-এর লোকসভা ভোট হোক এমনটাই চাইছে কেন্দ্রীয় সরকার। সে কারণেই ভোট এগিয়ে আনার একটি চিন্তা রয়েছে ক্ষমতাসীনদের, এমন কথাও আসছে ভারতীয় গণমাধ্যমে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা কী বলছেন?

রাজস্থান আর ছত্তিশগড়ে বিজেপি গেরুয়া পতাকা তুললেও সেই অর্থে কংগ্রেসের ভোট ২০১৮ সালের তুলনায় সে অর্থে বিশেষ কমেনি, আর মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেসের ভোট প্রায় ৯ শতাংশ কমলেও বিজেপির ভোটব্যাংক বাড়ার কারণ অন্য। মনে করা হচ্ছে, বিএসপি-সহ অন্যান্য দলগুলোর ভোট নিজেদের দিকে টেনে লাভবান হয়েছে গেরুয়া শিবির।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক শুভময় মৈত্র বলেন, 'এটা বিজেপির জন্য সেমিফাইনাল ছিল না। কারণ তারা এরই মধ্যে ফাইনালে পৌঁছে গেছে। এটা সেমিফাইনাল ছিল বিরোধী দলের জন্য।' শুভময় মৈত্র তিনটি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি ও বিরোধীদের ফলের ব্যাখ্যাও করেছেন। তিনি বলেন, 'আসনের দিক থেকে দেখতে গেলে বিজেপি ভালো ফল করেছে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই। অন্যদিকে এই তিনটি রাজ্যের নিরিখে গত লোকসভা ভোটে যেহেতু বিজেপি গত দুইবারই বেশ ভালো ফল করেছে, তাই সেখানে আর নতুন করে কিছু করার নেই।'

তিনি বলেন, 'বিজেপির নিরিখে এই তিন রাজ্যে খুব একটা পরিবর্তন হবে এমনটা নয়। এটা বিজেপিকে উজ্জীবিত করবে। আর তাই এটা বিজেপির কাছে সেমিফাইনাল নয়, এটা ছিল প্র্যাকটিস ম্যাচ। এবং তাতে তারা ভালো ফল করেছে।'

বিরোধীদের মধ্যে কংগ্রেসের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'এই তিন রাজ্যে কংগ্রেস এর আগে যা ভোট পেয়েছিল, প্রায় তাই-ই পেয়েছে। গত লোকসভায় তারা যা ভোট পেয়েছিল, তার তুলনায় ভোট বেড়েছে। সুতরাং আসনের হিসাবে কংগ্রেস পরাস্ত হলেও তাদের সমর্থকদের সংখ্যার যে খুব একটা পরিবর্তন হয়েছে, তেমনটা নয়। ঘটনাটা হলো, অন্য রাজনৈতিক দলগুলো যেমন সপা, সিপিআইএম এদের নিজেদের ভোট শতাংশটা আলাদাভাবে লড়ে এরা ধরে রাখতে পারেনি। এমন হতেই পারে এদের ভোটগুলোই বিজেপিতে চলে এসেছে।'

তিনটি রাজ্যের বিপুল জয় আসন্ন লোকসভা ভোটের পরিণামের ইঙ্গিত কিনা, সে প্রসঙ্গে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক বিশ্বনাথ চক্রবর্তী বলেন, নরেন্দ্র মোদি যে ক্ষেত্রে কিছুটা এগিয়ে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তবে বিরোধীরা একেবারে শেষ হয়ে গেছে, বা ২০২৩ সালের বিধানসভা ভোটের ফল ২০২৪-এর আসন্ন লোকসভা ভোটের ফল নির্ধারণ করে দিয়েছে, তেমনটাও নয়।

বিরোধীদের বক্তব্য

সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের ভরাডুবির পর কার্যত 'কোণঠাসা' হতে হয়েছে দলটিকে। প্রশ্নের মুখে রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বও। নির্বাচনী ফল প্রকাশের পর রাহুল গান্ধী অবশ্য 'জন আদেশ' মাথা পেতে নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেছিলেন, 'মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও ছত্তিশগড়ে জনগণের জন আদেশ আমরা মাথা পেতে নিচ্ছি। বিচারধারার লড়াই জারি থাকবে। তেলেঙ্গানার মানুষকে আমার অসংখ্য ধন্যবাদ। প্রজাপ্রিয় তেলেঙ্গানা বানানোর প্রতিশ্রম্নতি আমরা পালন করব।'

রাহুল গান্ধীর স্বীকারোক্তি অবশ্য তাকে শরিকদের তোপের মুখে পড়া থেকে রক্ষা করতে পারেনি। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যিনি 'ইনডিয়া জোটের' ও শরিক দলগুলোর মধ্যে একটি, বলেছিলেন, 'এটা মানুষের হার নয়, কংগ্রেসের হার। মানুষ বিজেপির বিরুদ্ধেই ভোট দিতে চেয়েছেন।' তিনি 'ইনডিয়া জোটের' শরিক দলগুলোর মধ্যে আসন ভাগাভাগির ওপর জোর দিয়ে বলেছিলেন, 'আমরা বারবার বলেছি, আসন ভাগ কর, না হলে এটা হয় না।'

কংগ্রেসের 'ভরাডুবির' ফলে শরিক দলের অনেকে 'ক্ষোভ' উগড়ে দিয়েছেন। তারা কংগ্রেসের মনোভাব নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। ন্যাশনাল কনফারেন্সের সহকারী সভাপতি ওমর আবদুলস্নাহর কথায়, নির্বাচনের সময় কংগ্রেস যা বলেছিল, তা ফাঁকা আওয়াজ বলে প্রমাণ হয়েছে। এর পাশাপাশি জোটের বিরুদ্ধে অবহেলার অভিযোগও তোলেন তিনি। এনসিপির প্রধান শরদ পাওয়ার মনে করেন, ছত্তিশগড়, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও মিজোরামের বিধানসভা নির্বাচনের ফলের প্রভাব বিরোধী জোটের ওপর পড়বে না। একই সুর ধরা পড়েছে শরিকদের অন্য নেতাদের মধ্যেও।

ইনডিয়া জোটের ভবিষ্যৎ

এই মুহূর্তে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ইনডিয়া জোট। তাদের শেষ বৈঠক হয়েছিল আগস্ট মাসের শেষে মুম্বাইতে। সে সময় একাধিকবার আলোচনার পরও কংগ্রেস হাইকমান্ড সারা ভারতে ইনডিয়া জোটের শরিকদের মধ্যে আসন ভাগাভাগি নিয়ে আলোচনার বিষয়ে 'উৎসাহ দেখায়নি' বলেই শরিক দলগুলোর মধ্যে অনেকে অভিযোগ জানিয়েছিলেন।

সম্প্রতি বিধানসভা ভোটের ফল প্রকাশের পর তড়িঘড়ি একটি বৈঠকের ডাক দিয়েছিলেন কংগ্রেসের সভাপতি মলিস্নকার্জুন খাড়্‌গে। ৬ ডিসেম্বর দিলিস্নতে ভারতের শরিক দলগুলোকে নৈশভোজের জন্য ডাকা হয়েছিল বলে কংগ্রেসের তরফে জানানো হয়েছিল। কিন্তু তৃণমূল-সহ একাধিক শরিক দল অভিযোগ করেছে, 'তাদের অনেকেই এই আমন্ত্রণের কথা জানতেনই না বা তাদের জানানো হয়নি।' এই পরিস্থিতিতে 'ইনডিয়া জোটের' বৈঠক বাতিল করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার মলিস্নকার্জুন খাড়্‌গের বাসভবনে ওই জোটের শরিকদলগুলোর সংসদীয় নেতাদের নিয়ে একটি বৈঠক হওয়ার কথা।

অন্যদিকে, রাজনৈতিক মহলের একাংশ মনে করছেন, বিধানসভা ভোটে কংগ্রেসের ব্যর্থতা 'জোটের' ওপর প্রভাব ফেলবে। একাধিক শরিক দল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে তোপও দেগেছে। এর মধ্যে মমতা ব্যানার্জিকে ইনডিয়া জোটের নেতৃত্বে আনার কথা বলছে তার দল।

মোদির জয়ের ইঙ্গিত?

ইনডিয়া জোটের শরিক দলগুলোর মধ্যে 'কোন্দল' ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে পড়বে কিনা, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। হিন্দি বলয়ে যেমন মোদির জনপ্রিয়তা স্পষ্ট, তেমনি দক্ষিণে কংগ্রেস বাজিমাত করেছে। তবে দক্ষিণে কর্ণাটক, কেরালা ও তামিলনাড়ু মিলিয়ে আসন ১২৯টি, আর উত্তরে ২২৯টি। দক্ষিণের ফল লোকসভা ভোটে কতটা প্রভাব ফেলবে তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

অন্যদিকে, বিরোধী হিসেবে ইনডিয়া জোটের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক শুভময় মৈত্র বলেন, 'লোকসভা নির্বাচনে বিরোধীরা বিরোধীদের মতোই লড়াই করতে পারেন, নিজের নিজের জায়গায়। ২০০৪ সালে পোস্ট পোল অ্যালায়েন্স যেমনটা হয়েছিল, তারা যদি ভালো ফল করে, তাহলে সেটাই হবে। সেভাবে তারা জিতবে। এই মুহূর্তে দক্ষিণ ভারতে বিজেপির ফল হয়তো ততটা ভালো নয়। আর হিন্দি হার্ট লাইনে বিজেপির ভালো ফল হওয়ার সম্ভাবনা।'

প্রশ্ন উঠেছে, তিন রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের ফল ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের পরিণামের ইঙ্গিত দেয় কি না। অধ্যাপক বিশ্বনাথ চক্রবর্তী মনে করেন, এখনই অনুমান সম্ভব নয়। তার কথায়, 'ঠিক এভাবেই ছত্তিশগড়, রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশে বিপুল জয়ের পর অটল বিহারি বাজপেয়ি ২০০৪ সালে লোকসভা নির্বাচন এগিয়ে এনেছিলেন। কিন্তু তার পরিণাম ভালো হয়নি। কাজেই সাম্প্রতিক তিন রাজ্যের নির্বাচনের ফল দেখে ২০২৪ সালের পরিণাম এখনই বলা সম্ভব নয়। মোদি এগিয়ে আছেন এটা বলার কারণ, কংগ্রেসের পক্ষে ইনডিয়া জোটকে এখনই নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অবস্থায় নেই। আর ছোট শরিক দলগুলোর পক্ষে এখনই বিজেপির বিরুদ্ধে আগ্রাসনের সঙ্গে এগোনো সম্ভব নয়। তার একটা বড় কারণ তৃণমূলের মতো দলগুলো ইডি ও সিবিআই-এর মতো গোয়েন্দা সংস্থাদের সামলাতেই ব্যস্ত। সংবাদসূত্র : বিবিসি নিউজ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে