শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় বাড়ছে ধর্ষণ-নিগ্রহ-পৈশাচিকতা

ধর্ষণ তথা যৌন নির্যাতন হ্রাসের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে রাষ্ট্র। যদি ধর্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া যায়, তাহলে এ ঘটনা হ্রাসের পাশাপাশি বন্ধও হতে পারে। রাষ্ট্রের পাশাপাশি এ ক্ষেত্রে সমাজ এবং পরিবারও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
আজহার মাহমুদ
  ১১ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০০:০০

পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং শিক্ষাঙ্গনসহ সর্বক্ষেত্রে অবক্ষয়ের ছাপ আজকের পৃথিবীতে। আমাদের চারপাশে আজ নৈতিক মূল্যবোধগুলো হারিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখা যায়। ভীতসন্ত্রস্ত, অশান্তি ও অস্থিরতা বাড়ছে পুরো পৃথিবীজুড়ে। ফলে পারিবারিক কলহ, অবাধ যৌনাচার, অশ্লীলতা, যৌন বিকৃতি, কুরুচিপূর্ণ সমকামী ও বহুকামিতার মতো পশুসুলভ যৌন আচরণ সমাজকে নিয়ে যাচ্ছে অবক্ষয়ের দ্বারপ্রান্তে। সোস্যাল মিডিয়া ফেসবুক, অনলাইন ও প্রিন্ট মিডিয়ার খবরের প্রায় ৫০% খবরই সমাজিক অবক্ষয়ের। পত্রিকা পাতা খুললেই চোখে পড়ে স্বামীর হাতে স্ত্রী খুন, স্ত্রীর হাতে স্বামী খুন, প্রেমিকার হাতে প্রেমিক খুন, প্রেমিকের হাতে প্রেমিকা খুন, ভাইয়ের হাতে ভাই খুন, ছেলের হাতে মা খুন, পুত্রের হাতে পিতা খুন ইত্যাদি ইত্যাদি। এখন খুন, ধর্ষণ, গুমের খবর তো নিয়ম মাফিক সংবাদে পরিণত হয়েছে।

এছাড়াও বর্তমান সময়ে অবাধে নারী ও শিশু ধর্ষণের ঘটনাগুলো ভয়াল আকার ধারণ করেছে। কোনোভাবেই যেন ধর্ষণকে আটকানো যাচ্ছে না। প্রতিদিনই ঘটছে পৈশাচিক ধর্ষণ। এই অবস্থায় আইন ও বিচারের পাশাপাশি ধর্ষণ প্রতিরোধে প্রয়োজন গণসচেতনতা এবং সামাজিক আন্দোলন। যদিও আমি মনে করি, সচেতনতাই অনেকাংশ পারে ধর্ষণরোধ করতে।

এছাড়াও ধর্ষণ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ তরুণ-তরুণীদের অবাদ মেলামেশা। এই মেলামেশার কারণে সৃষ্টি হয় যৌন আকর্ষণ। যা এক সময় ধর্ষণে রূপ নেয়। তাই এজন্য আমি দায়ী করব পুরো সমাজকেই। যারা অভিভাক রয়েছেন তাদেরই এ দায় নিতে হবে। সন্তানকে এ বিষয়ে সঠিকভাবে জ্ঞান দিতে হবে। তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে অবাদ মেলামেশার ক্ষতি কি।

শুধু তাই নয়, ধর্ষণরোধে প্রয়োজন ধর্মীয় মূল্যবোধ সৃষ্টি করা। আমরা যতই আধুনিক হচ্ছি, ততই ঝুঁকে পড়ছি নোংরামির দিকে। আমাদের ভেতর থাকছে না ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং নৈতিকতার ভয়। যার কারণে এ সমস্ত কাজ করতে আমরা একমুহূর্তের জন্যও চিন্তা করি না। আমাদের ভেতর এখন শিষ্টাচার এবং নৈতিক মূল্যবোধের মাত্রা নেই বললেই চলে। যার কারণে নারী-পুরুষের অবাদ মেলামেশা সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের ভেতর এখন চক্ষুলজ্জাও নেই। যার ফলস্বরূপ ধর্ষণ।

আমরা যদি সাম্প্রতিক সময়ে ধর্ষণের ঘটনাগুলোর দিকে নজর দিই, দেখা যাবে আশঙ্কাজনক হারে ধর্ষণের সংখ্যা বেড়ে গেছে। পত্রিকার পাতা থেকে কিছু নিকট অতীতের কিছু সংবাদ জানিয়ে দিতে চাই আপনাদের। গত ২০ আগস্ট কুড়িগ্রামে প্রেমের ফাঁদে ফেলে এক কিশোরীকে দলবেঁধে ধর্ষণ করা হয়। গত ১৫ আগস্ট নারায়ণগঞ্জে এক যুবকের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে এক কিশোরী ধর্ষণের শিকার হয়। গত ১১ আগস্ট ফরিদপুরে অসুস্থ বাবার জন্য ওষুধ কিনতে গিয়ে গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৪ বছরের এক কিশোরী। গত ১৯ আগস্ট নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুলস্নায় এক পোশাককর্মী (১৮) গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন। গত ১৭ আগস্ট গাজীপুরে চাকরি দেয়ার কথা বলে এক নারী পোশাক শ্রমিককে ধর্ষণ করে দুই যুবক।

এসব ঘটনা হচ্ছে অতি সামান্য। মূলত এর দশগুণ বেশি ঘটনা ঘটে দেশে। আজকাল বিভিন্ন অনলাইন পোর্টালের একটি অংশ থাকে ধর্ষণের খবরের জন্য। যেখানে গেলে পাওয়া যায় সব ধর্ষণের খবর। ভেবে দেখুন এই ধরনের ঘটনা কত পরিমাণ ঘটলে এমনটা হয়।

মূলত পারিবারিক ও সামাজিক প্রথা, সংস্কার ধূলিসাৎ, সামাজিক ও নৈতিকতার চরম অবক্ষয়, তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার বিশেষ করে ল্যাপটপ-কম্পিউটার-মোবাইল ফোন এবং ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা ও জবাবদিহিতাবিহীন ব্যবহারের সুযোগ, পর্নগ্রাফির অবাধ বিস্তার, বিশ্ব সংস্কৃতির নেতিবাচক দিকের আগ্রাসনই ধর্ষণের ঘটনা বাড়িয়ে দিয়েছে। এ সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুর্বল পারিবারিক বন্ধন, দুর্বল সামাজিক কাঠামো, অশিক্ষা, কুশিক্ষা, দারিদ্র্য, বিচারহীনতা। আরও রয়েছে স্থানীয় ও জাতীয় সংস্কৃতি চর্চার অভাব, সুষ্ঠু ও সুস্থ ধারার বিনোদনের অনুপস্থিতি, কিশোর-কিশোরীদের ক্রীড়া-কর্মকান্ডের অভাব ইত্যাদি। সমাজে যতসংখ্যক ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে, ততটার বিচারের খবর আমরা পাই না। গণমাধ্যমে এ ধরনের খবর তেমন একটা দেখা যায় না। বরং অনেক ক্ষেত্রে ধর্ষকরা শুধু পারই পায় না, পুরস্কৃতও হয়।

ধর্ষণ তথা যৌন নির্যাতন হ্রাসের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে রাষ্ট্র। যদি ধর্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া যায়, তাহলে এ ঘটনা হ্রাসের পাশাপাশি বন্ধও হতে পারে। রাষ্ট্রের পাশাপাশি এ ক্ষেত্রে সমাজ এবং পরিবারও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

\হসাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে এ ধরনের এক ঘটনার প্রতিবাদে আন্দোলন চলছে। এ আন্দোলনের মাধ্যমে যৌন নির্যাতনের ঘটনা হ্রাস সম্ভব। এতে ধর্ষক ও নিপীড়ক বার্তা পায়। ফলে দুর্ঘটনা হ্রাস পেতে পারে।

আমরা মূলত ফ্রয়েডের তত্ত্বের ওপর দাঁড়িয়ে যৌনতাকে ব্যাখ্যা করে থাকি। কিন্তু সভ্যতার অগ্রগতি আর সময়ের পরিবর্তনে যৌনতা আরও বিস্তৃত এবং পরিশীলিত হয়েছে। যেহেতু ধর্মে-সমাজে, রাষ্ট্রে-আইনে যৌনতা নিষিদ্ধ নয়, তাই এটা থাকবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে দরকার নৈতিক অনুষঙ্গ। নৈতিক মোড়ক না থাকলেই দেখা দেবে বিশৃঙ্খলা। তাই সামাজিক ও জাতীয় জীবনে নৈতিক মূল্যবোধ সুগঠিত ও সুসংগঠিত করতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার ও অশুভ বিস্তার ঠেকাতে হবে। বিশ্ব সংস্কৃতির নেতিবাচক উপাদানও নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এসবের দায়িত্ব রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবারের। পাশাপাশি আমাদের বহু ঐতিহ্যের পারিবারিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য লালন করতে হবে। তাহলে যদি অশুভের এই সুনামি প্রতিরোধ করা যায়। এছাড়া কখনো এই অশুভ শক্তিকে প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। এজন্য সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টাও অত্যন্ত জরুরি।

আজহার মাহমুদ : প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<111588 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1