শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

করোনাকালে শিক্ষা সংকট

ছাত্রছাত্রীরা হাসিমুখে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে স্কুলে যাবে। তাদের মনে কোনো দুশ্চিন্তা থাকবে না। তারা স্কুলের মাঠে ছোটাছুটি করবে। শিক্ষার সংকট কেটে গিয়ে আবার আপনগতিতে এগিয়ে চলবে নতুন প্রজন্ম।
অলোক আচার্য
  ২২ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০০:০০

বৈশ্বিক মহামারি করোনার প্রভাবে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি সাধন হচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থায়। কারণ সবকিছু করোনার মধ্যেই প্রায় স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরলেও শিক্ষাব্যবস্থার স্বাভাবিক হতে আরও সময় প্রয়োজন। কারণ শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা। এ সময়ে শিক্ষার যে প্রায় অচলাবস্থা তার ফল আমাদের আরও বহুবছর ভোগ করতে হবে। এখন চ্যালেঞ্জ হলো করোনাভাইরাসের প্রকোপ থেকে নিজেকে এবং বিশ্বকে রক্ষা করার চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ নিয়েই আমরা এখন নিজেদের ঘরবন্দি করে রাখছি। এখন স্কুল-কলেজ সব কিছু বন্ধ রয়েছে। অনেক দেশ স্কুল খুলে আবার করোনার প্রকোপের কারণে বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। আবার সম্প্রতি করোনা আতঙ্কের মধ্যেই স্কুল খুলে দেয়া হয়েছে ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে। সংক্রমণ প্রতিরোধে কঠোরভাবে করোনা স্বাস্থ্যবিধি পালনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। করোনার যেখান থেকে উৎপত্তি বলা হয়, সেই চীনের উহানেও ১ সেপ্টেম্বর থেকে স্কুল খুলে দেয়া হয়েছে। চলতি মাসের শুরুতে সেই তালিকায় রয়েছে ব্রিটেন, ফ্রান্স, পোল্যান্ড ও রাশিয়া। আর অনেক দেশ সেই পথেই হাঁটতে যাচ্ছে। অর্থাৎ দীর্ঘদিন পর লাখ লাখ শিশু স্কুলে ফিরছে। তবে সারা বিশ্বে এটি হতে আরও সময় প্রয়োজন। ততদিন ভরসা অনলাইন ক্লাস। করোনাভাইরাসের কারণে স্কুলগুলো বন্ধ থাকায় বিকল্প হিসেবে এই অনলাইন ক্লাস শুরু হয়েছে। করোনার কারণে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি কিছুটা

পোষিয়ে নিতে এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তবে বিশ্বের সব দেশের সামর্থ্য সমান না হওয়ার সফলতা ক্ষেত্র বিশেষে হেরফের হয়েছে। জাতিসংঘ শিশু উন্নয়ন তহবিল ইউনিসেফ জানাচ্ছে, অনলাইন ক্লাসের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এক তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থী। এর কারণও মূলত একটাই। অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণ করার মতো সুযোগ অর্থাৎ ডিভাইস বা ইন্টারনেট সংযোগ না থাকা ইত্যাদি।

ইউনিসেফের সেই প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ ও ইলেকট্রনিক সুবিধা না থাকায় বিশ্বজুড়ে আনুমানিক ৪৬ কোটি ৩০ লাখ শিশু অনলাইন ক্লাসে অংশ নিতে পারছে না। ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক হেনরিয়েটট্রা ফোরে বলেন, মাসের পর মাস ধরে এত শিশু শিক্ষা কার্যক্রম থেকে বঞ্চিত থাকা শুধু নিছক একটি সংখ্যা নয়, এটা বৈশ্বিক শিক্ষা সংকট। আগামী কয়েক দশক ধরে অর্থনীতি ও সমাজে এর প্রতিক্রিয়া অনুভূত হতে পারে। শিক্ষার সংকট ধারণাটি করোনাকালীন সময়ে বেশি উপলব্ধি হচ্ছে। কারণ এ রকম পরিস্থিতি যা একটি মহামারি এবং এখানে কোনো কাজই জীবনের চেয়ে মূল্যবান হতে পারে না, এমন একটি পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে শিক্ষা কার্যক্রম আপাতত বন্ধ বা বিকল্প উপায়ে চালিয়ে নেয়া থেকে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছুই হতে পারে না। বৈশ্বিক এই শিক্ষা সংকট আমাদের পিছিয়ে দিয়েছে। তবে এখান থেকে আমাদের শেখার মতো কিছুও রয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম হলো আমাদের আরও দ্রম্নততম সময়ে ডিজিটালাইজেশনের চূড়ান্তরূপে যেতে হবে। সবার কাছে আধুনিক ডিভাইস পৌঁছাতে হবে। প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। ইন্টারনেটের যুগে তা আরও সহজলভ্য করতে হবে। যদি এরকম পদ্ধতি আরও আগেই থাকত তাহলে লেখাপড়ার কাজটিও ঘরে বসেই শেষ করা যেত এবং প্রতিটি শিক্ষার্থীই এই সুযোগ নিতে পারত। কিন্তু যেহেতু এ রকম পর্যাপ্ত সুযোগ এখনো গড়ে ওঠেনি এবং এটা আমাদের একটি সাফল্যের সঙ্গে শুরুমাত্র; ফলে কিছু সমস্যা থেকেই যায়। জাতিসংঘ আনুমানিক এক হিসাবে জানিয়েছে, মহামারি ঠেকাতে জারি লকডাউন ও স্কুল বন্ধ থাকায় বিশ্বজুড়ে ১৫০ কোটি শিশুর পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বার্তা সংস্থা এপি বলছে, সব অঞ্চলে পরিসংখ্যানটি অবশ্য এক রকম নয়। যেমন অনলাইন ক্লাস থেকে বঞ্চিত হওয়ার দিক থেকে ইউরোপের শিশুরা যতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আফ্রিকা বা এশিয়ার দেশগুলোর চেয়ে তা অনেকটা কম।

প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, যেসব শিশুর অনলাইন ক্লাসে যুক্ত হওয়ার সুযোগ আছে তারাও নানা ধরনের বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। এর মধ্যে বাড়িতে পরিবেশ না থাকা, পরিবারের কাজ করার চাপ অথবা তাদের কাছে থাকা ডিভাইসের সমস্যা দেখা দিলে তা সমাধান করার মতো কারিগরি সহযোগিতার অভাব ইত্যাদি। করোনার কারণে সৃষ্ট ক্ষতি সামলাতে সব দেশের সামর্থ্য সমান না হওয়াটা স্বাভাবিক। কারণ শিল্পন্নোত দেশগুলো বহু আগেই ডিজিটালাইজেশনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। ইউরোপ আমেরিকার দেশগুলো উন্নত এবং সেখানে পরিস্থিতি ভিন্ন। তুলনামূলক দরিদ্র দেশগুলোতে এই সমস্যা বেশি হবে। কারণ সবার হাতে অনলাইন কস্নাস করার মতো আধুনিক ডিভাইস না থাকা। এই সমস্যা হঠাৎ মেটানো সম্ভব নয়।

কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতি এমন যে করোনাকালীন সময়ে শিক্ষার্থীদের মনোযাগ ধরে রাখাটাই চ্যালেঞ্জের। সময়টা বড় দীর্ঘ। এই দীর্ঘ সময়ে তাদের মানসিক অবস্থায়ও প্রভাব পড়ছে। তারা ডিজিটাল উপকরণে লেখাপড়ার বাইরে গেমস খেলায় নেশার মতো জড়িয়ে পড়ছে। কারণ শিক্ষাক্ষেত্রে সামগ্রিকভাবে অন্যান্য বিষয়ের মতোই প্রভাব ফেলবে। এ সময় থেকে বের হতে আমাদের সময়ের প্রয়োজন হবে। শিক্ষার্থীরাও এক সময় করোনার পর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাবে। কিন্তু শিক্ষায় অনেক জট তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে। সেই জট শিক্ষার্থীদেরই ভোগাবে। এইচএসসি পরীক্ষার সঙ্গে শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়টি জড়িত। আবার সেশন জটের বিষয়টিও রয়েছে। মূল প্রভাবই হবে সময়ের হেরফের। শিক্ষার ক্ষেত্রে করোনা যে বৈশ্বিক সংকট তৈরি করেছে তা আরও কতদিন চলবে বলা সম্ভব না। কারণ অনেক দেশ স্কুল খুলে আবার বন্ধ করেছে। তাই কোনো রকম ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবে না। শিক্ষা কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হবে কিন্তু জীবন তার থেকেও বহুগুণে মূল্যবান। যে কোনো সময়েই শুরু করা সম্ভব, তবে তা অবশ্যই নিরাপদ হতে হবে। করোনাভাইরাসের প্রভাবে সময় যখন থমকে দাঁড়িয়েছে তখন আমাদের অপেক্ষা করতেই হবে। বাকি সবকিছুর মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও একদিন স্বাভাবিক হবে।

ছাত্রছাত্রীরা হাসিমুখে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে স্কুলে যাবে। তাদের মনে কোনো দুশ্চিন্তা থাকবে না। তারা স্কুলের মাঠে ছোটাছুটি করবে। শিক্ষার সংকট কেটে গিয়ে আবার আপন গতিতে এগিয়ে চলবে নতুন প্রজন্ম।

অলোক আচার্য :কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<112809 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1