শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
পাঠক মত

সড়কে লাশের মিছিল থামছে না

নতুনধারা
  ১৮ জানুয়ারি ২০২১, ০০:০০

সড়কে লাশের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। কোনোভাবেই যেন থামানো যাচ্ছে না। সড়ক দুর্ঘটনা এখন মনে হয় আমাদের দেশে একটা নিয়মে পরিণত হয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনা এখন একটা জাতীয় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশে এমন কোনো দিন নেই যে, দেশের কোনো না কোনো জায়গায় সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে না। সকালে ঘুম থেকে উঠলেই সংবাদ মাধ্যমে দেখে সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের মৃতু্যর খবর। সড়কে মৃতু্যর মিছিল থামছে না। বেপরোয়া বাস-ট্রাকের ধাক্কায় বা চাপায় মৃতু্যর সংখ্যা বাড়ছে, মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। করোনার কারণে গত বছরের অন্তত ৯ মাস যান চলাচল স্বাভাবিক ছিল না। এখনো স্বাভাবিক নয়। কিন্তু দুর্ঘটনা ও মৃতু্যর সংখ্যা কমেনি বরং বেড়েছে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য, গত বছরের ডিসেম্বরে সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪০২টি। তাতে মৃতু্য হয়েছে ৪৬৪ জনের। আগের মাসে অর্থাৎ নভেম্বরে দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪১৭টি। তাতে মৃতু্য হয়েছে ৪৩৯ জনের। দু'মাসের এই পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে, নভেম্বরে দুর্ঘটনার সংখ্যা ডিসেম্বরের চেয়ে কিছুটা বেশি হলেও মৃতু্যর সংখ্যা ডিসেম্বরের তুলনামূলকভাবে কম হলেও মৃতু্যর সংখ্যা বেশি। এই ধারা নতুন বছরেও অব্যাহত আছে। বছরের প্রথম তিন দিনে দুর্ঘটনা ঘটেছে সর্বমোট ১৬টি। তাতে মৃতু্য হয়েছে ২৯ জনের। দুর্ঘটনা ও মৃতু্যর সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। কারণ সব দুর্ঘটনা ও মৃতু্যর খবরই পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয় না। দেখা যাচ্ছে, তিন দিনের প্রতিদিনে গড়ে প্রায় ১০ জনের মৃতু্য হয়েছে। আবার দুর্ঘটনার হিসাবে প্রতি দুর্ঘটনায় প্রায় দুজনের মৃতু্য হয়েছে। প্রতি বছর এভাবে কয়েক হাজার সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে এবং তাতে হাজার হাজার মানুষ মারা যায়। একই সঙ্গে হাজার হাজার মানুষ আহত হয়। দুর্ঘটনা ও মৃতু্য-দুই-ই মর্মান্তিক ও বেদনাদায়ক। এর মধ্যে এমন কিছু দুর্ঘটনা ও মৃতু্য ঘটতে দেখা যায়, যা মানুষকে অধিক মাত্রায় মর্মাহত ও বেদনার্ত। এমনও দেখা যায়, দুর্ঘটনায় একই পরিবারের একাধিক ব্যক্তি কিংবা পরিবারের সবারই মৃতু্য ঘটে। এ ধরনের মৃতু্য মানুষকে হতবিহ্বল এবং গভীর শোকের মধ্যে নিক্ষেপ করে। চলতি বছরের প্রথম ও তৃতীয় দিনে এরূপ দুটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। প্রথম দিনের ঘটা দুর্ঘটনায় একই সঙ্গে তিন বোন মারা গেছে। তৃতীয় দিনের দুর্ঘটনায় একই পরিবারের ছয়জন মারা গেছে। তিন বোনের মৃতু্যর দুর্ঘটনাটি ঘটেছে নরসিংদীর জঙ্গুয়া এলাকায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে। তাদের বহনকারী প্রাইভেটকারের সঙ্গে একটি বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষ হলে তারা তিনজনসহ চালক নিহত হয়। তৃতীয় দিনের দুর্ঘটনাটি ঘটেছে ময়মনসিংহের গাছতলা এলাকায় নেত্রকোনা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে। বাস ও অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে একই পরিবারের ছয়জন চালকসহ ঘটনাস্থলেই মারা যায়। নিহতদের একজন ছিল সদ্য প্রসূত। হাসপাতাল থেকে তাকে নিয়ে বাড়ি আসার পথে ঘটে এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। তিনদিন আগে যার জন্ম, দুর্ঘটনা তাকে স্বজনসহ নিয়ে গেছে মৃতু্যর ওপারে যেখানে একবার গেলে কেউ ফিরে আসে না। সড়ক দুর্ঘটনায় এরকম পরিবারের একাধিক সদস্যের মৃতু্য বা পরিবারহানির ঘটনা। বলা বাহুল্য, মোটেই নতুন নয়। গত বছরও এমন বেশকিছু ঘটনা ঘটেছে। আগেও ঘটতে দেখা গেছে। প্রাইভেটকার, সিএনজি- এ ধরনের ছোট যানের সঙ্গে বাস-ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছে। তাতেই মৃতু্য হয়েছে যাত্রীদের। বাস-ট্রাক রাস্তাঘাটে যেভাবে চলাচল তাতে যে কোনো সময় প্রাণহানিকর দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা থাকে। কখনো কখনো এ আশঙ্কা সত্যে পরিণত হয়। চালকরা এতটাই বেপরোয়া যে, কোনো কিছুতেই তারা তোয়াক্কা করে না। একথা সবারই জানা। সড়ক দুর্ঘটনার অধিকাংশের জন্য দায়ী বেপরোয়া চালক। তাদের এই পরোয়াহীন আচরণ ও প্রবণতা কোনো কিছুতেই বন্ধ করা যাচ্ছে না। চালকদের একটি বড় অংশ প্রশিক্ষিত ও দক্ষ নয় এবং তাদের বৈধ লাইসেন্সও নেই। তারাই অধিকাংশ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। কয়েক লাখ এমন যানবাহন রয়েছে, যাদের ফিটনেস নেই। লাইসেন্সবিহীন চালক ও ফিটনেসবিহীন যানবাহন বন্ধ করতে পারলে দুর্ঘটনা অনেক কমে যেতে পারে। চালকের লাইসেন্স দেওয়া ও যানবাহনের ফিটনেস সার্টিফিকেট দেওয়ার কর্তৃপক্ষ আছে। তাদের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। এই অভিযোগের প্রতিকার এবং তাদের কাজের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা যায়নি। সড়ক ও সেতুবিষয়ক মন্ত্রণালয় আছে। তার যিনি মন্ত্রী, তিনি সরকারি দলের দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি। তার মন্ত্রণালয় থেকে এ পর্যন্ত যত নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সেগুলোর অধিকাংশই সংশ্লিষ্টরা প্রতিপালন করেনি। কেন এই অমান্য ও ব্যত্যয়, তার কোনো জবাব নেই। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হলে সড়কে শৃঙ্খলা, যাতায়াতসহজতা ও নিরাপত্তা বেশি নিশ্চিত হতো, দুর্ঘটনাও কমত।

মন্ত্রী অনেক বিষয়েই কথা বলেন, অন্য বিষয়ের পাশাপাশি তার মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত বিষয়ও থাকে। তিনি ক্ষেত্রবিশেষ হুমকি- ধমকিও দেন। কিন্তু তার কথা ও হুমকি-ধমকির প্রভাব কার্যক্ষেত্রে প্রতিফলিত হতে কমই দেখা যায়। মহাসড়কে ধীরগতির যান যেমন অটোরিকশা, নসিমন, করিমন, ভটভটি চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়। অথচ এসব যানবাহন দিব্যি চলাচল করছে এবং কখনো কখনো মর্মান্তিক দুর্ঘটনার কারণ হচ্ছে এদের চলাচল বন্ধ করা যায়নি। সড়ক শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বিধানে পুলিশ আছে বটে, কিন্তু দাতাদের দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে তেমন দেখা যায় না। সড়ককে সুশৃঙ্খল, বাধামুক্ত ও নিরাপদ করতে হবে। এ ব্যাপারে অনুসরণ করতে হবে শূন্য সহিষ্ণুতার নীতি। যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত তাদের ছোট-বড় সবাইকে দায়িত্বশীল হতে হবে। জবাবদিহির সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আইন করে দুর্ঘটনা ও মৃতু্য রোধ করা যাবে না, যদি আইন সম্পর্কে অজ্ঞ থাকে এবং আইনের প্রতি অবজ্ঞা করার প্রবণতা থাকে আইন যানবাহন মালিক, চালক, পথচারী, যাত্রী, পুলিশসহ সবাইকে জানাতে হবে। তাদের তা জানতে হবে এবং মানতে হবে। কারও ক্ষেত্রে অমান্য লক্ষ করা গেলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

ওসমান গণি

কুমিলস্না

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে