শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
পাঠক- মত

নদীভাঙন রোধ ও বন্যানিয়ন্ত্রণ করুন

নতুনধারা
  ১৩ জুন ২০২১, ০০:০০

জ্যৈষ্ঠের দাবদাহে প্রশান্তির বৃষ্টি প্রকৃতিকে শীতল করে দেয়। বৃষ্টির স্নিগ্ধ ছোঁয়া শরীর, মন, প্রকৃতিকে করে সতেজ। আনুষ্ঠানিকভাবে বর্ষা মৌসুম না এলেও বৈশাখের মাঝামাঝি কিংবা জ্যৈষ্ঠের শুরু থেকেই বৃষ্টির দেখা মেলে। সাময়িক বৃষ্টি সবারই ভালো লাগে, পুলকিত করে মন। বৃষ্টি নিয়ে কবিতা, গল্পের শেষ নেই কবি-লেখকদের। বৃষ্টি নতুন নতুন ভাবনা ভাবাতে শেখায়। মন ভালো করতেও কিন্তু বৃষ্টির জুড়ি নেই। কিন্তু কখনো কখনো ভালো থাকার কাল হয়ে দাঁড়ায় বৃষ্টি। ভালোর মুখোশ পরে বেদনায় ভাসিয়ে দেয় আমাদের। জ্যৈষ্ঠ থেকেই ভারী বর্ষণের দেখা মেলে। ভারী বর্ষণে তলিয়ে যায় পথ-ঘাট, নদী-নালা। বৃষ্টিতে নিচু রাস্তাগুলোয় পানি জমে, জল থই থই করে চারদিক। অতি বর্ষণ, ভারী বর্ষণে দেশের গ্রামাঞ্চল থেকে শুরু করে রাজধানী ঢাকার রাস্তাও পানিবদ্ধ হয়ে থাকে। সম্প্রতি বৃষ্টির দেখা মিলছে প্রায় দিনই, বর্ষা ঋতুর দেখা না মিলতেই জলাবদ্ধতায় ভুগতে হচ্ছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলকে। এ যেন নিয়মিত মৌসুমী দৃশ্যে পরিণত হয়েছে। গ্রামাঞ্চল না হয় দূরে থাকল, রাজধানী ঢাকার বেশকিছু অঞ্চলে হালকা বৃষ্টিতেই প্রায় হাঁটুসম পানিতে ভরে যায়।

বর্ষায় সবচেয়ে বড় ভোগান্তির নাম বন্যা। বন্যায় দেখা যায় অসহায়ত্বের করুণ রূপ। বাস্তবতার আয়নায় ভাসে বেদনা, দুর্ভোগ। বন্যার ক্ষতিগ্রস্ততা প্রভাব ফেলে অর্থনীতিতে যেটা বয়ে বেড়াতে হয় পুরো অর্থবছর। প্রায় প্রতি বছরই বন্যার দেখা মেলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। তলিয়ে দেয় ঘর-বাড়ি, জনজীবন করে দেয় বিপন্ন। মে মাস থেকেই মূলত বৃষ্টির রাজত্ব শুরু হয়। জুন-জুলাই বর্ষার অফিসিয়াল সময় হওয়ায় সেই সময়টায় যেন বৃষ্টির তান্ডব চলে। বৃষ্টিতে বেড়ে যায় নদীর জল। বাঁধ ভেঙে ডুবে যায় শহর-গ্রাম। শুধু যে বৃষ্টির কারণেই নদীর জল বাড়ে তাও নয়। অনেক সময় জোয়ারের জলে উতলে যায় নদী। সম্প্রতি পদ্মানদীর জল বাড়তে শুরু করেছে। একদিনে ১০ সে.মি পানি বেড়েছে। তলিয়ে যাচ্ছে নিচু জমি। বাংলাদেশের নদ-নদীর পানির ৯৩ শতাংশ আসে উজানের দেশগুলো তথা ভারত, নেপাল, ভুটান থেকে। বাংলাদেশের ইতিহাসে ভয়াবহ বন্যা ঘটে ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালে। ১৯৮৮ সালের বন্যায় দেশের ৬১% এবং ১৯৯৮ সালের বন্যায় ৬৮% এলাকা পস্নাবিত হয়েছিল। অগণিত মানুষ, গবাদিপশু মারা যায় এসময়। ক্ষতি হয় কয়েকশ কোটি টাকা। এখনো প্রতি বছর বন্যা হলেও এত ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় না। তবে এখনো বন্যার ভয়াবহতা চোখ ভিজিয়ে দেয়। গত দশকেও বন্যার ভয়াবহতা কাঁদিয়েছে বাঙালিকে। প্রথম আলোর সূত্র এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলের প্রায় ২৮ লাখ মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় ছিল। বন্যার কারণে বাড়িঘর ও ফসল হারিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২৬ লাখ মানুষ। পানিবন্দি ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের প্রকৃত সংখ্যা সরকার উলিস্নখিত সংখ্যার চেয়ে বেশি ছাড়া কম হবে না। বন্যার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে উলেস্নখযোগ্য কারণ হলো নদীভাঙন। নদীভাঙনের কারণেই মূলত বন্যার প্রসার ঘটে দ্রম্নততার সঙ্গে। নিমিষেই বসতভিটা নদী জলে তলিয়ে যাওয়ার উদাহরণ অহরহ। বিশেষ করে নদীতীরবর্তী এলাকাবাসীরা বর্ষা এলেই দুশ্চিন্তা কাঁধে বয়ে নিয়ে বেড়ায়, না জানি কখন ভিটে-মাটি শূন্য হতে হয়। গত বছরের বন্যায় চোখের সামনে মাদারীপুরের তিনতলা একটা স্কুল নদীর বুকে ঢলে পড়ে। যার অন্যতম ও একমাত্র কারণ নদীভাঙন। পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে জানা যায় গত চার দশকে মোটামুটি এক লাখ হেক্টর জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। নদীভাঙন এখন বড় মাপের দুর্যোগ বলে গণ্য হলে পরিতাপ ও পরিহাসের বিষয় যে ১৯৯৩ সালের আগে নদীভাঙনকে সরকারিভাবে দুর্যোগ বলা হতো না। স্বীকৃতি না থাকায় বিভিন্ন সরকারি অনুদান থেকে বঞ্চিত হলেও নদীভাঙন রোধে সরকারি পদক্ষেপের কমতি ছিল না। নদীভাঙন যে শুধু অতি বৃষ্টির কারণেই হচ্ছে তা কিন্তু নয়। শুধু প্রকৃতিকে এই দায় দেওয়া নিছক দায়সারা কাজ। নদীভাঙন হওয়ার একটা মূল কারণ নদীর নাব্য কমে যাওয়া। আর নাব্য কমে যায় মূলত নদীতে অতিরিক্ত ময়লা, আবর্জনা, শিল্প-কারখানার বর্জ্যের কারণে। এসব ময়লা-আবর্জনা নদীর তলদেশে জমে গিয়ে ধীরে ধীরে নদী তার গভীরতা হারায় আর যে কারণে বর্ষা এলে নদী জল ধরে রাখতে না পেরে উপচে যায়, নদীভাঙন শুরু হয়, শুরু হয় সব হারানোর খেলা। নদীভাঙনের আরেকটি কারণ বাঁধ নির্মাণ সঠিকভাবে না হওয়া। প্রতি বছরই সরকারিভাবে বাঁধ নির্মাণ, পুনর্নির্মাণের জন্য অর্থ বরাদ্দ করা হয়। অর্থ ঠিকই সরকারি খাত থেকে ব্যয় হয় কিন্তু কাজ ঠিকঠাকভাবে হয় না। অসৎ ঠিকাদারীদের জন্য কাজ ঠিকভাবে হয় না যার দরুণ অল্প সময়েই বাঁধ ভেঙে যায়, সৃষ্টি হয় বন্যা।

ঝড়সহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষ তার ভিটে-মাটি অন্তত পায় কিন্তু নদীভাঙনে মানুষ হারিয়ে ফেলে তার সর্বস্ব। বন্যার ক্ষয়-ক্ষতিতে সচল অর্থনীতির চাকা হঠাৎ করেই উল্টো পথে ঘুরতে থাকে। বন্যায় যে শুধু মানুষ সর্বস্ব হারায় তাও নয়, সঙ্গে সঙ্গী হয় পানিবাহিত বিভন্ন রোগ। ডায়রিয়া, কলেরার মতো রোগ আষ্টেপৃষ্ঠে থাকে। একে তো সব হারিয়ে শোকে কাতর তার উপর রোগ যেন যমদূত হয়ে দাঁড়ায়। বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে আসছেন তবু এই সমস্যা থেকে নিস্তার পাওয়া যাচ্ছে না। বন্য নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারের কিছু বিধি নিষেধ জারি করা জরুরি। এর মধ্যে আছে নদী এলাকায় যেন বাড়ি-ঘর উঁচু করে, নদীতে যেন ময়লা-আবর্জনা ফেলানো না হয় এমন বিভিন্ন কার্যকর পদক্ষেপ। বন্যা শুরুর আগে সরকারি ও বেসরকারিভাবে বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে ভুক্তভুগীদের নিয়ে যাওয়া হয় কিন্তু সেসব জায়গায় স্বাস্থ্যবিধি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এদিকে এবছরও বন্যা হওয়ার আশঙ্কা করেছে আবহাওয়াবিদরা। নদীতে পানি বাড়ছে দুর্বার গতিতে। মে মাসে বৃষ্টি তুলনামূলক কম হলেও জুনের শুরু থেকে বৃষ্টি হচ্ছে। সারা মাসজুড়েই বৃষ্টির আশঙ্কা করা হচ্ছে। এবছরও বৃষ্টিতে বিভিন্ন এলাকার রাস্তা পানির বেশ নিচে। এর মধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রামের মতো বিভাগীয় শহর ও উলেস্নখযোগ্য। দেশের নিচু স্থানগুলো, বিশেষ করে যেসব জায়গায় পানি জমে সেসব জায়গা উঁচু করতে হবে অচিরেই। এদিকে সড়ক ও জনপথ মন্ত্রণালয়ের সচেষ্ট ভূমিকা জরুরি। আসন্ন বন্যা কিংবা নদীভাঙন আটকানো সম্ভব না হলেও নিজেদের সচেতন থাকতে হবে। পানি বাড়তে নিলেই প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরিয়ে ফেলতে হবে। গবাদিপশুদের নিরাপদ দূরত্বে রাখতে হবে। বন্যায় পানিবাহিত রোগ যেন না ছড়ায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বন্যায় ভোগান্তি ঠেকানোর উপায় নেই কিন্তু ভোগান্তি কমানোর সুযোগ আছে। যার জন্য সরকারি এবং বেসরকারি বিভিন্ন উদ্যোগ জরুরি। আশ্রয়কেন্দ্র বন্যার সময়ে অবধারিত স্থান কিন্তু ভুক্তভুগীদের তুলনায় সেই সংখ্যাও কম। করোনার জন্য স্বাস্থ্যবিধি মানা জরুরি। সব কিছু বিবেচনা করে আশ্রয় কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। করোনায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে, যদি বন্যার সময়ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা না হয় সে ক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। পানিবাহিত রোগ যেন না ছড়ায় সেজন্য বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থা করতে হবে। সেই সঙ্গে পাশাপাশি পানি বিশুদ্ধকরণের ট্যাবলেট ও পানির ট্যাংক মজুত রাখতে হবে। বন্যাতেও মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক রাখতে হবে। সর্বোপরি বন্যা নিয়ন্ত্রণে সরকারি, বেসরকারি, স্বেচ্ছাসেবী সবার এগিয়ে আসার পাশাপাশি বিত্তবানদের এগিয়ে আসা জরুরি। কারণ মানুষ মানুষের জন্য আর জীবন জীবনের জন্য। মোদ্দাকথা, বন্যা যেন না হয় সেসব পদক্ষেপের পাশাপাশি সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে এখনই।

বিশাল সাহা

শিক্ষার্থী, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ

ঢাকা কলেজ, ঢাকা

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে