শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ; শেকড়ে বাঙালি ও মনুষ্যত্ব

আজিজুল রমিজ
  ২০ অক্টোবর ২০২১, ০০:০০

যুগযুগ ধরে ইসরাইল কর্তৃক ফিলিস্তিনি নিধন, আফগানিস্তানে বারবার সাম্রাজ্যবাদীদের দখল ও হস্তক্ষেপ, তালেবানের মতো উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠীর ক্ষমতা দখল সভ্যতার দাবিদার মানবজাতির জন্য কলঙ্কজনক অধ্যায়।

এবারের দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে কুমিলস্নায় যে অঘটন ঘটে গেল তা নিয়ে দেশবাসী উদ্বিগ্ন। বড় কিছু ঘটে যাওয়ার আগে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হোক। সচেতন মানুষ মাত্রই অনুমান করতে পারবেন এ দেশে ধর্ম নিয়ে যারা ব্যবসা করে, রাজনীতি করে এটা তাদেরই অপকর্ম। এমন ব্যবস্থা নেওয়া হোক যেন ধর্মের নামে কেউ কখনো নৈরাজ্যের পরিবেশ সৃষ্টি করার দুঃসাহস না পায়। সংখ্যালঘু রক্ষায় আরও কঠোর আইন করা হোক। কারণ এ ধরনের সাম্প্রদায়িক ঘটনা বা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি নতুন কিছু নয়।

১৯৯০ সালে ভারতে বাবরি মসজিদ ভাঙার খবরে বাংলাদেশে ঘটে ভয়াবহ হিন্দু-মুসলিম সহিংসতা যার বীভৎসতা চলমান ছিল ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত। ২৮ ফেব্রম্নয়ারি ২০১৩ সালে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবু্যনালে জামায়াত নেতা মাওলানা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর মৃতু্যদন্ড ঘোষণা হলে জামায়াতে ইসলামী এবং এর ছাত্র সংঘটন ইসলামী ছাত্র শিবির সারাদেশে হিন্দুদের উপর সহিংসতার ঘটনা ঘটায়। ২০১৬ সালে নাসিরনগর উপজেলায় ৩০ অক্টোবর হিন্দুদের উপর ঘটে এক ভয়াবহ হামলা। ১৭ মার্চ ২০২১, সুনামগঞ্জের শালস্না উপজেলায় হিন্দুপলস্নীতে হামলা সেদিনের ঘটনা। এ সব অঘটন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের জন্য অশনিসংকেত নয় কী?

প্রত্যেকটি ধর্মেই এমন কিছু আদর্শ আছে যা সুন্দর ও মানবিক। প্রকৃতপক্ষে মানবতাই 'মানুষের' একমাত্র ধর্ম। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। ধর্মের নামে পৃথিবীজুড়ে শুধু যুদ্ধ, জাতিগত প্রতিহিংসা, সাম্রাজ্যবাদ ও ধর্ম ব্যবসা। চারদিকে শুধু আনুষ্ঠানিকতার বাড়াবাড়ি। অবশ্য এর কারণও আছে। ধর্মে যে মানবিক দিকগুলো রয়েছে তা নিয়ে ব্যবসা বা রাজনীতির সুযোগ নেই। বরং সাম্রাজ্যবাদের জন্য, অপরাজনীতির জন্য ধর্মের অপব্যবহার একটা মোক্ষম হাতিয়ার। রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মের তোষণ কিংবা ধর্মের নামে নিপীড়ন পৃথিবীর একটি ব্যাধি।

ব্যক্তিগত কিছু অভিজ্ঞতার কথা বলি-

এক. ছেলেবেলায় ভালো ছবি আঁকতাম। আম্মা হাদিস কোরআনের কথা বলে কঠোর শাসন করতেন। ছবি আঁকা বন্ধ হলো। এখন বুঝি ছবি আঁকার সঙ্গে শেরিক গুনাহের কোনো সম্পর্ক নেই। আমি শিশু ছিলাম, ছবি এঁকেছি মনের আনন্দে। শেরিক গুনাহ হচ্ছে এমন কাজ যার মাধ্যমে কেউ নিজেকে ঈশ্বর মনে করে, আলস্নাহর সাথে অন্য কাউকে তুলনা করে।

দুই. আমি যে কলেজে পড়াই মেয়েদের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে উৎসাহিত করতে গিয়ে তিক্ত এক অভিজ্ঞতা হয়েছে। অনেক পরিশ্রম করে পুরো মাস ওদের রিহার্সেল করাই। প্রায় মেয়েরাই অনুষ্ঠানের দিন এসে বলে- স্যার, আমরা এ সব পারব না। কারণ জানতে চাইলে গুনাহের কথা বলে। এই কথা মেয়েদের নয়, কেউ তাদের নিরুৎসাহিত করেছে বুঝতে পারি। কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে কিছুই করার থাকে না।

তিন. কবিতা লিখতাম বলে কিছু কিছু বন্ধু আমাকে হাদিস, কোরআনের রেফরেন্স দিয়ে বলত, তুমি অকারণে সময় নষ্ট করছ। কবিরা বিভ্রান্ত, অন্ধকারে হাতরে বেড়ায়।

ঠিক ভেবে পাই না, ওসব কথা ওরা কোথায় পেয়েছে? যতদূর জানি, হাদিস ও কোরআনের আয়াত সংক্রান্ত জটিলতা সমাধান সাধারণের কাজ নয়। একটি আয়াত কোন প্রেক্ষিতে নাজিল হয়েছে, হাদিসটি নবী কাকে বলেছেন, সম্পূর্ণ কোরআন নাজিলের আগে নাকি পরে বলেছেন? তা ছাড়া আরবি ভাষা বিশ্লেষণ সহজ কিছু নয়। এ সব বিষয় সাধারণের জানার কথা নয়। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই ইসলামী স্কলারদের পরামর্শ অনস্বীকার্য। প্রায়ই দেখি, সাধারণ মুসলমানরা এ সব কিছু না ভেবেই দাড়ি, টুপি, নবী মাটির তৈরি নাকি নূরের তৈরি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে হিংসা-বিবাদে জড়ায়।

চার. কিছুদিন আগে আমার কিছু ছাত্রী অনার্স পাসের খবর দিতে আসে। ওদের মধ্যে একটি মেয়ে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে। শুনে খুব খুশি হলাম। বললাম, এখন থেকেই চাকরি খোঁজো অথবা স্বউদ্যোগে কিছু করার চেষ্টা করো। মেয়েটি হেসে বলল-স্যার, আর কিছুই করা সম্ভব নয়। এই পর্যন্ত আসতে বেশ যুদ্ধ করতে হয়েছে। পরিবারে কেউ চায় না, আমি জব করি।

পাঁচ. কিছুদিন আগে হিন্দু উত্তরাধিকার আইন সংশোধন নিয়ে একটি কলাম লিখেছিলাম। এ কারণে কিছু সনাতন বন্ধুর মনঃক্ষুণ্ন হয়েছে। মুসলমান বন্ধুরাও কম কিছু বলেনি। ওদের কাছে এমন কিছু অপযুক্তি শুনতে হয়েছে যা এই একবিংশ শতাব্দীতে একজন শিক্ষিত মানুষের কাছে প্রত্যাশিত নয়। একদিকে দেবী দূর্গা এবং কালীকে বলা হচ্ছে সব সৃষ্টির মূল বা আদ্যাশক্তি, অন্যদিকে যুগের পর যুগ নারীকে সম্পত্তির উত্তরাধিকার দেওয়ার বেলায় চরম কুণ্ঠাবোধ! এমন পরস্পরবিরোধী আচরণ ও যুক্তি কখনোই ধার্মিকের হতে পারে না। এ সব পরস্পরবিরোধী যুক্তি শুনলে সাধারণের মনে ধর্মের উপযোগিতা নিয়েও প্রশ্ন জাগে। আমার ধর্ম কতটা সুন্দর বা অসুন্দর সেটা বোঝা যায় আমার আচরণ এবং চিন্তা-চেতনা দেখে।

ভেবে পাই না, বিগত ২০০ বছরে পৃথিবী কত পাল্টে গেছে! সনাতন ধর্মেও এসেছে সংস্কার। সতীদাহ প্রথা বন্ধ হয়েছে, বিধবা বিবাহ ও হিন্দু বিবাহ রেজিস্ট্রার চালু হয়েছে। এমন আরও অনেক কিছুই হয়েছে।

অথচ একটি বিশেষ ধর্মের নারী পিতা ও স্বামীর সম্পত্তির উত্তরাধিকার পায় না এ দেশে! এটুকু ন্যায্য কথা বলতে গেলেই একদল বলতে থাকবে-ধর্ম গেল! যুগের পর যুগ এ উপমহাদেশে ধর্মের নামে বাধাগ্রস্ত হয়ে আসছে শিক্ষা সংস্কৃতি, বিজ্ঞানমনস্কতা ও নারী অধিকার।

কথা বললে কথা বাড়তে, কুতর্ক বাড়বে। যা না বললেই নয়, ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতিতে যতবার ধর্মের ব্যবহার হয়েছে শুভ কিছু হয়নি। '৪৭-এর দেশভাগ ও রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা, ধর্মকে ব্যবহার করে দীর্ঘ ২৪ বছর পাকিস্তানিদের শোষণ-নির্যাতন, একাত্তরে ইসলামের নামে এ দেশেরই কিছু দুষ্কৃতিকারীদের সঙ্গে নিয়ে লাখ লাখ নিরীহ নারীশিশুকে ধর্ষণ, মুক্তিযোদ্ধা ও বুদ্ধিজীবীদের হত্যা; পৃথিবীর জঘন্যতম জেনোসাইড যা কখনোই ভোলার নয়। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার কম হয়নি। কাটাছেঁড়া করা হয়েছে পবিত্র সংবিধান। স্বাধীনতাবিরোধীরা সংসদে গিয়েছে, নোংরা হাতে জাতীয় পতাকা উড়িয়েছে। ফলে বাধাগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষা-সংস্কৃতি, প্রগতির অগ্রযাত্রা।

রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার, ধর্মীয় মতভেদের জটিলতা ও ভয়াবহতা ইউরোপীয়রা উপলব্ধি করছে ৪০০ বছর আগে। আমেরিকানরাও পিছিয়ে নেই। এ সব দেশে ধর্ম ব্যক্তিগত, রাষ্ট্র সবার। সময় বৈরী হওয়ায় কিছু বিপরীত চিত্র যে নেই, সে কথা বলা যাবে না। তবে তা মধ্যপ্রাচ্যের মতো আত্মঘাতী নয়। এমনকি ভারত উপমহাদেশের মতোও নয়।

মধ্যপ্রাচ্যের যে আগুন, বিশ্বজুড়ে সাম্রাজ্যবাদের উত্থান কিংবা ভারতীয় উপমহাদেশে যুগ যুগ ধরে সংখ্যালঘু নির্যাতন, এ সবের প্রধান জ্বালানি ধর্ম। এ সব সত্য সবাই জানি। সত্য যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করতে পারব ততই মঙ্গল।

বদলে যাওয়া পৃথিবীর দিকে তাকাতে হবে। শান্তি ও সমৃদ্ধি চাইলে, যারা এগিয়ে যাচ্ছে, সংখ্যায় কম হলেও তাদের সঙ্গেই চলতে হবে। যারা মসজিদে বোমা মারছে, স্কুলগামী শিক্ষার্থীর বুকে গুলি ছুঁড়ছে ওদের দিকে তাকানো যাবে না। বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরতে হবে। সোচ্চার সাহসী হতে হবে। সব রাজনৈতিক দল ও সাংস্কৃতিক সংগঠনকে মানবিক দেশ গড়ার প্রত্যয়ে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন করে পথ চলতে হবে। কোনো অবস্থাতেই ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার করা যাবে না।

বর্তমান পৃথিবীর প্রায় সব রাষ্ট্র চিন্তাবিদ, রাজনীতিক, দার্শনিকরা রাজনীতি থেকে ধর্মকে পৃথক করার পক্ষে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বাঙালির শেকড় অনুসন্ধিৎসু সবাই এমনটাই বিশ্বাস করেন। ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে লাখো প্রাণের দামে অর্জিত স্বাধীনতাকে অর্থবহ করতে হলে '৭২-এর সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠা সময়ের দাবি।'

শিক্ষা-সংস্কৃতি এবং মানবিক আলোয় উজ্জ্বল, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ ফিরে পাবো বাঙালি ঐক্যের শেকড়ে ড. মুহম্মদ শহীদুলস্নার ভাষায়- 'আমরা হিন্দু বা মুসলিম যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি।' অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠায়, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণে, অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে সবাই সতর্ক থাকি। বাঙালির হাজার বছরের যে সংস্কৃতি, 'বারো মাসে তেরো পার্বণ' চিরঞ্জীব হোক। ধর্মে-বর্ণে হৃদ্যতা অটুট থাকুক। বাঙালি সংস্কৃতিই হোক বাংলাদেশিদের একমাত্র পরিচয়। ধর্মের নামে রাজনৈতিক ব্যবসা বন্ধ হোক।

আজিজুল রমিজ: শিক্ষক, লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে