শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
পাঠক মত

পারস্পরিক সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ সুখী পরিবারের ভিত্তি

নতুনধারা
  ২৩ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০

একটি সুখী, প্রশান্তিময় পরিবার আমরা সবাই চাই। বাইরে যত কাজই করি, দিন শেষে আমাদের ঘরে ফিরতেই হয়। ঘরে ফিরে আমরা দেখতে চাই স্ত্রীর হাসিমুখ, স্বামীর মমতাময় আচরণ, মা-বাবার স্নেহের ছায়া, সন্তানের উচ্ছলতা- যেখানে সবাই মিলে প্রশান্তির অনুরণনে হয়ে যায় একাকার।

কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক পরিবারে যেন প্রত্যেকেই একা- সম্পর্কের সেই উষ্ণতা, সেই আবেগ কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে। সন্তানের সঙ্গে মা-বাবার দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছে, বন্ধ দরজার ওপাশে সে একা। স্বামী-স্ত্রী পাশাপাশি থেকেও, মনের দূরত্ব যোজন যোজন।

এর একটি বড় কারণ হিসেবে যেটি খুঁজে পাওয়া গেছে, সেটি হলো আমরা অন্যের প্রাপ্য সম্মানটুকু দিতে খুব বেশি কার্পণ্য করি। সবসময় শুধু পেতে চাই এবং প্রত্যাশা পূরণ না হলে আমাদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়। আর এ থেকেই শুরু হয় সম্পর্কের টানাপড়েন। অনেকের কাছে স্ত্রী দাসীর মতো, স্বামী প্রভু। এ জন্য মূলত দায়ী আমাদের অবিদ্যা আর ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে গৃহে আমরা নারীকে দাবিয়ে রাখতে চাই তার প্রাপ্য সম্মানটুকু দিই না। দেখা গেছে, একজন নারী যিনি কর্মক্ষেত্রে কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার- বাড়িতে কোনো বিষয়ে তার কিছু বলার নেই। কোনো সিদ্ধান্ত বা মতামত দিতে দেওয়া হয় না। একটা কথা প্রচলিত আছে- শাদির প্রথম রাতে বধিবে বেড়াল। অর্থাৎ বিয়ের প্রথম রাতেই শায়েস্তা কর, তাহলে আর কোনোদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। এ সমস্যা শুধু নিম্নবিত্ত বা বিত্তহীন পরিবারগুলোতে নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী স্বামী তার সমান যোগ্যতাসম্পন্ন স্ত্রীকে পেটাতে একটুও দ্বিধা করেন না। সন্তানদের সামনেই গায়ে হাত তুলছেন, বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলছেন। আর স্ত্রী তার সন্তানদের ভবিষ্যৎ কী হবে- এটা ভেবে সব অত্যাচার নীরবে হজম করছেন। এই উদাহরণ দেওয়ার জন্য দূরে কোথাও যেতে হবে না। ঘরেই ঘরেই হামেশা ঘটছে।

আমাদের দেশে এখন অনেকেই নারী অধিকারের ব্যাপারে খুব সোচ্চার। অধিকার আদায়ের নামে নারী আন্দোলন বিভিন্ন সেমিনার, সভা আলোচনা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে একটি সত্য ঘটনা- এক সেমিনারে একজন স্বনামধন্য বিশিষ্ট ব্যক্তি আলোচনা করছিলেন নারীদের অধিকার নিয়ে। অনেক ভালো ভালো, অনেক বড় বড় কথা তিনি বললেন। তার স্ত্রীও সে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। বাসায় ফেরার পর এক কথায় দু'কথায় দু'জনের মধ্যে তর্ক শুরু হলো, এরপর উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়। একপর্যায়ে স্বামী ব্যক্তিটি স্ত্রীকে জোরে এক থাপ্পড় দিয়ে বসলেন। স্ত্রীও উত্তপ্ত। বললেন, এতক্ষণ নারী অধিকার নিয়ে এত বড় বড় কথা বললে আর এখন তুমি আমার গায়ে হাত তুলছো। স্বামী আরও জোরে চিৎকার দিয়ে বললেন, চুপ করো। এ অধিকার অন্য নারীদের জন্য, তোমার জন্য নয়। এই হচ্ছে বাস্তবতা।

আবার এমন আছে যে স্ত্রীরাও অনেক ক্ষেত্রেই স্বামীকে সম্মান করেন না আবার অনেকে ভয় করেন- কী জানি কী হয়। যদি আরও খারাপ ব্যবহার করেন, যদি ডিভোর্স দেন- এই আশঙ্কায় তারা সব সময় তটস্থ থাকেন, যার প্রকাশ ঘটে কখনো দুর্ব্যবহারে আর হীনম্মন্যতায় আক্রান্ত হয়ে।

অথচ ১৫০০ বছর আগে থেকেই নারীকে সব অধিকার দেওয়া আছে, এটা আমরা দেখি না। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে- বিশ্বাসী নর-নারীর পুরস্কার সমান। নারী এবং পুরুষ পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক। স্বামী-স্ত্রী একে অপরের পোশাক। আলস্নাহতায়ালা যেখানে সমান মর্যাদা দিয়েছেন সেখানে আমরা নারীকে দাবিয়ে রাখতে চাই।

নবীজী (সা.) বলেছেন, মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত। নারীর কত বড় সম্মান! নবীজীকে (সা.) একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল- আলস্নাহ ও তার রসুলের পর কে সবচেয়ে বেশি সম্মানিত ও শ্রদ্ধেয়? নবীজী (সা.) বললেন, তোমার মা। তারপর কে? তোমার মা। তারপর কে? তোমার মা। তারপর কে? তোমার বাবা। তিনবার মা বলার পর তিনি বাবার কথা বলেছেন। কত বেশি সম্মান দিয়েছেন আলস্নাহ ও তার রসুল।

যদি সন্তানদের কথা বলি তবে দেখব অনেক মা-বাবা আছেন যারা সন্তানদের সামনে ঝগড়া থেকে শুরু করে মারামারি পর্যন্ত করেন। সন্তান যখন মা-বাবাকে ঝগড়া করতে দেখে তখন তার মধ্যে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। সে ভাবে, মা-বাবা যদি আলাদা হয়ে যায় আমার কী হবে? মা-বাবার চিন্তার চেয়েও তার নিজের অনিশ্চয়তার তুফান তার মধ্যে বয়ে যেতে থাকে। ৮-৯ বছরের সন্তান মা-বাবার সামনেই কাউন্সিলরদের কাছে সহযোগিতা চাইছে- আমার মা-বাবাকে ঠিক করে দিন না, আমার অনেক কষ্ট হয়!

আপনারা যদি একজন আরেকজনকে শ্রদ্ধা করতে না পারেন, কখনো প্রত্যাশা করবেন না, সন্তান আপনাদের শ্রদ্ধা করবে। তার ভেতরে দুঃখবোধ তৈরি হবে, হাহাকার তৈরি হবে।

অনেক সময় দেখা যায় বাবা রাত করে বাড়ি ফেরে। মা যদি সন্তানকে বলেন, তোর বাবা এত রাত করে বাড়ি ফেরে, কোথায় যায়, কী করে। আবার বাবাও যদি সন্তানকে তার মা কত খারাপ এটা বোঝানোর জন্য অনেক কিছু বলে থাকেন। এই সন্তানও মা-বাবাকে সম্মান করতে শেখে না, শ্রদ্ধা করতে শেখে না।

আবার অনেক মা সন্তানদের বলে থাকেন, দেখেছিস তোর দাদি আমার সঙ্গে কী আচরণ করেছে? আবার স্বামী হয়তো স্ত্রীকে বললেন, তোমাদের বাড়িতে কখনোই আমাকে ঠিকমতো আদর-যত্ন করে না, জামাইকে কেউ এভাবে খাওয়ায়? এই যে পরস্পরের আত্মীয়ের নিন্দা- এটা খুব দুঃখজনক। যে সন্তান এগুলো শুনে বড় হচ্ছে সে কখনো সুন্দর আচরণের অধিকারী হবে না। মা-বাবার মধ্যে কেউই এমন কোনো আচরণ করা উচিত নয় যেটা তাকে মা-বাবার প্রতি অশ্রদ্ধাশীল করে তোলে।

ছোট কিংবা বড় প্রতিটি মানুষের নিজস্ব ব্যক্তিত্ব রয়েছে। বয়সভেদে সবাইকেই সম্মান করা উচিত। সেটি সন্তানের বেলায়ও প্রযোজ্য। সন্তানের কোনো অন্যায় বা তার যে কোনো দোষ-ত্রম্নটি অন্যের সামনে বলা উচিত নয়। এটি তার আত্মসম্মানে বাধে এবং মা-বাবার প্রতি ক্ষোভ তৈরি হয়। এই ক্ষোভের বাহ্যিক প্রকাশ দেখা দেয় একটু বড় হওয়ার পর। কেউ হীনম্মন্যতায় ভোগে, কেউ জেদি হয়। সন্তানের বয়স যা-ই হোক না কেন তারও একটা আত্মসম্মানবোধ রয়েছে। সেই সম্মানটুকু তাকে দিতে হবে।

লোমান হাকিম

শিক্ষার্থী

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে