শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সামাজিক অবক্ষয় ভয়ংকর আকার ধারণ করেছে

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের সুনাম বেড়েছে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি ইত্যাদি ইতিবাচক ঘটনার পাশাপাশি সামাজিক অপরাধ, অনৈতিকতা, সন্ত্রাস ও অবক্ষয়ের মতো নেতিবাচক দিকগুলোও নষ্ট করে দিচ্ছে ইতিবাচক অর্জন। শিক্ষাক্ষেত্র থেকে পেশাগত কর্মস্থল পর্যন্ত সর্বত্র এই ব্যাধির ভয়ানক বিস্তার ঘটেছে। এ সব রোধ করতে না পারলে একদিকে যেমন সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে অন্যদিকে দেশের মানুষ থাকবে নিরাপত্তাহীন। পাশাপাশি ভবিষ্যতের জন্য ভয়ংকর বিপদ ডেকে আনবে। সুতরাং, সময় থাকতেই সাবধান হওয়া সমীচীন।
সালাম সালেহ উদদীন
  ০৬ জুলাই ২০২২, ০০:০০

সামাজিক অবক্ষয় দিনে দিনে চরম আকার ধারণ করেছে। হেন কোনো অপরাধ নেই, যা সমাজে সংঘটিত হচ্ছে না। স্ত্রী স্বামীকে, স্বামী স্ত্রীকে, মা-বাবা নিজ সন্তানকে, ভাই ভাইকে, বন্ধু বন্ধুকে অবলীলায় হত্যা করছে। স্ত্রী স্বামীর লাশ ছয় টুকরা করে রাস্তায় ফেলে দিচ্ছে। স্বামী ঠুনকো কারণে স্ত্রীকে সন্তানসহ হত্যা করছে। এমন কি প্রেমের কারণে অর্থ-সম্পত্তির লোভে সমাজে এসব অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। অন্যদিকে হতাশা, নিঃসঙ্গতা, বঞ্চনা ও অবিশ্বাস আর অপ্রাপ্তিতে সমাজে আত্মহননের ঘটনাও বেড়ে গেছে। বেড়ে গেছে মাদকাসক্তের সংখ্যা। মাদকের অর্থ জোগাড় করতে না পেরে ছেলে খুন করছে বাবা-মাকে, স্বামী খুন করছে স্ত্রীকে কিংবা পরিবারের অন্যান্য সদস্যকে। অন্যের সম্পত্তি আত্মসাৎ করার জন্য কিংবা কাউকে ফাঁসিয়ে দেওয়ার নিমিত্তে নিজের সন্তানকে হত্যা পর্যন্ত করছে। ছাত্র হত্যা করছে শিক্ষককে, বিনা অপরাধে শিক্ষকের গলায় জুতার মালা পরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সমাজে ধর্ষণ, গণধর্ষণ ও নারী নির্যাতন অবমাননা আগের চেয়ে অনেকগুণে বেড়েছে। এসব ঘটনা সামাজিক অবক্ষয়ের চূড়ান্ত নজির।

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, সমাজের স্বাভাবিক ও সুস্থ গতিপ্রবাহ রক্ষা করার দায়িত্ব কার- সরকার, স্থানীয় সরকার, সমাজপতি, নাকি সমাজের সচেতন মানুষের। সমাজ পুনর্নির্মাণের দায়িত্বই বা কার? আপতদৃষ্টিতে এই সব প্রশ্ন সহজ মনে হলেও এর সমাধান বেশ জটিল। সমাজে নানা শ্রেণিপেশার মানুষ বসবাস করে, বিচিত্র এদের মানসিকতা ও রুচি। এদের কোনো সমান্তরাল ছাউনির মধ্যে আনা কঠিন। তবে সামাজিক ভারসাম্য রক্ষা, সামাজিক অপরাধ কমিয়ে আনাসহ নানা পদক্ষেপ নিতে হবে সম্মিলিতভাবে। সমাজ রক্ষা করা না গেলে পরিবার রক্ষা করা যাবে না, ব্যক্তিকে রক্ষা করাও কঠিন হয়ে পড়বে। বাংলাদেশে সমাজ পরিবর্তনের উপাদানগুলো ব্যাখ্যা করা জরুরি। সমাজ পরিবর্তন মানে সামাজিক কাঠামো ও সমাজের মানুষের কার্যাবলি এবং আচরণের পরিবর্তন। তাদের মানসিকতার পরিবর্তন। অপরাধপ্রবণ অসহিষ্ণু মানসিকতা নিয়ে মানুষ এ সমাজে বসবাস করছে।

আসলে আমরা আজ যে সমাজে বাস করছি সে সমাজ আমাদের নিরাপত্তা দিতে পারছে না; এমনকি যে রাষ্ট্রে বাস করছি সে রাষ্ট্রও নিরাপত্তাদানে অপারগ। আমরা নানারকম সামাজিক ও রাষ্ট্রিক সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করেও বারবার ব্যর্থ হচ্ছি। পা পিছলে ক্রমান্বয়ে নিচের দিকে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছি। সমাজের একজন সুস্থ এবং বিবেকবান মানুষ হিসেবে এমন পরিস্থিতিতে আমাদের করণীয় কী তা নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। কি সামাজিক ক্ষেত্রে, কি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে- সবক্ষেত্রেই অবক্ষয় দেখতে পাচ্ছি- যা একজন শান্তিকামী মানুষ হিসেবে আমরা স্বাধীন ও একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কল্পনা করতে পারছি না। এ অবক্ষয় ইদানীং আরও প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে এবং সমাজ কাঠামোকে নড়বড়ে করে ফেলছে। মনের মধ্যে সারাক্ষণ ঘুরপাক খাচ্ছে, আমরা কোন সমাজে বসবাস করছি। এটা কি সভ্য সমাজ? মানুষের প্রকৃত রূপ কি এমনই।

সামাজিক মূল্যবোধ তথা ধৈর্য, উদারতা, কর্তব্যনিষ্ঠা, ন্যায়পরায়ণতা, শৃঙ্খলা, শিষ্টাচার সৌজন্যবোধ, নিয়মানুবতির্তা, অধ্যবসায়, নান্দনিক সৃষ্টিশীলতা, দেশপ্রেম, কল্যাণবোধ, পারস্পরিক মমতাবোধ ইত্যাদি নৈতিক গুণাবলি লোপ পাওয়ার কারণেই সামাজিক অবক্ষয় দেখা দেয়- যা বতর্মান সমাজে প্রকট। মনে রাখতে হবে, বিশৃঙ্খল সমাজে বসবাস করে উন্নত রুচি ও সংস্কৃতির অধিকারী হওয়া যায় না। আমরা চাই, পরিকল্পিত ও বিন্যস্ত সমাজ। নীতিবোধ ও চারিত্রিক মূল্যবোধ সমাজ গঠনের প্রধান শক্তি- যা আমরা হারিয়ে ফেলেছি।

প্রশ্ন হচ্ছে, তাদের এই অধঃপতনের জন্য দায়ী কে? দায়ী আমরাই। আমরাই নিজেকে সুপথে পরিচালিত করতে পারছি না। এর পাশাপাশি ঘুষ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, দখল ও দলীয়করণের ব্যাপারটি তো দেশের সবর্ত্রই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। এ পরিস্থিতি থেকে কে আমাদের পরিত্রাণ দেবে এবং কে-ই বা আমাদের পথ দেখাবে? নৈতিক শিক্ষার প্রথম ও প্রধান কেন্দ্র হচ্ছে পরিবার। পরিবারের সদস্যরা যদি নৈতিক হয় তা হলে সন্তানরাও নৈতিক ও মানবিক হয়ে উঠবে। সামাজিক মূল্যবোধ আজ কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে- তা সাম্প্রতিক শিক্ষক হত্যাসহ নানা অপরাধমূলক ঘটনার দ্বারাই প্রমাণিত হয়।

আমরা দীর্ঘদিন থেকেই লক্ষ্য করে আসছি, ধর্ষণ ও হত্যার মতো বিপজ্জনক অপরাধমূলক প্রবণতা সমাজে ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজন সামাজিক ও পারিবারিক সচেতনতা। এই দায়িত্ব নিতে হবে পরিবার ও সমাজকেই। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রেরও যথেষ্ট করণীয় রয়েছে। সমাজের এক শ্রেণির বর্বর পাষন্ড মানুষের হাতে অনেকের জীবনই বিপন্ন হয়ে পড়ছে, অবলীলায় জীবন চলে যাচ্ছে। এমনকি শিশুর জীবনও চলে যাচ্ছে আপনজনের হাতে। এই অবক্ষয়ের আরেক চিত্র ইদানীং সমাজে শিক্ষক হত্যার ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাওয়া। শিক্ষকরা ছাত্রদের কাছে কোনো দিক থেকেই এখন আর নিরাপদ নয়। নানা কারণে তাদের জীবনঝুঁকি বেড়ে গিয়েছে। ছাত্রদের নৈতিক অবক্ষয় এত চরমে যাবে, ভাবাই যায় না।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের সুনাম বেড়েছে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি ইত্যাদি ইতিবাচক ঘটনার পাশাপাশি সামাজিক অপরাধ, অনৈতিকতা, সন্ত্রাস ও অবক্ষয়ের মতো নেতিবাচক দিকগুলোও নষ্ট করে দিচ্ছে ইতিবাচক অর্জন। শিক্ষাক্ষেত্র থেকে পেশাগত কর্মস্থল পর্যন্ত সর্বত্র এই ব্যাধির ভয়ানক বিস্তার ঘটেছে। এ সব রোধ করতে না পারলে একদিকে যেমন সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে অন্যদিকে দেশের মানুষ থাকবে নিরাপত্তাহীন। পাশাপাশি ভবিষ্যতের জন্য ভয়ংকর বিপদ ডেকে আনবে। সুতরাং, সময় থাকতেই সাবধান হওয়া সমীচীন।

যারা সমাজকে, রাষ্ট্রকে পদে পদে কলুষিত করছে, সমাজকে ভারসাম্যহীন ও দূষিত করে তুলছে, সমাজের মানুষের নিরাপত্তা ও অধিকার ক্ষুণ্ন করছে তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। আদর্শ ও গণমুখী রাজনীতি দখল করে নিয়েছে দুর্বৃত্ত অপরাধী পরিবেষ্টিত রাজনীতি। ক্ষমতা ও পেশি শক্তির বলে রাজনীতিকরা হেন কোনো অপরাধ নেই যে, তারা করছেন না। এর প্রভাব পড়ছে সমাজে। ফলে সামাজিক অপরাধ তীব্র হচ্ছে। সরকারের পরিকল্পিত দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ এবং সামাজিক আন্দোলন বেগবান হলেই এর থেকে মুক্তি মিলতে পারে, অন্যথায় নয়।

সালাম সালেহ উদদীন : কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক ও কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে