সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

লাঙ্গলবন্দ :পুণ্যস্নানে পাপ মুক্তি

সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয়ের এই তিন দেবতা হচ্ছেন গুণাতীত পরম ব্রহ্মের প্রথম গুণময় স্বরূপ। বর্তমান যুগে এই তিন দেবতার মধ্যে বিষ্ণু এবং শিবের পূজা বহুরূপে করা হলেও ব্রহ্মার আরাধনা সে তুলনায় অপ্রতুল। এই পটভূমিতে ব্রহ্মতেজের উৎস হতে সৃষ্ট বাংলাদেশের মহাতীর্থ লাঙ্গলবন্দকে এক ব্যতিক্রমী আধ্যাত্মিক ক্ষেত্ররূপে স্বীকার করতে হবে।
তারাপদ আচার্য্য
  ২৯ মার্চ ২০২৩, ০০:০০

সনাতন ধর্মীয় চেতনায় মহাবিশ্বের সৃষ্টি রহস্য গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করে যে, দৃশ্যমান এবং দৃষ্টির অতীত ব্রহ্মান্ড সৃষ্টির আগে একমাত্র অস্তিত্বমান সত্ত্বা ছিলেন গুণাতীত পরম ব্রহ্ম। এই একক সত্তা বহু হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করলেন। পরম ব্রহ্মের বহু নামের মধ্যে তিনি ঈশ্বর নামেও পূজিত ও স্মরণীয়। ঈশ্বর বহু হওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করায় সর্বপ্রথম তিন গুণের প্রতীক হিসাবে তিন রূপে তার প্রকাশ ঘটল।

এই তিন রূপ হলেন- সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা, পালনকর্তা বিষ্ণু এবং প্রলয়ের অধীশ্বর মহেশ্বর শিব।

সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয়ের এই তিন দেবতা হচ্ছেন গুণাতীত পরম ব্রহ্মের প্রথম গুণময় স্বরূপ। বর্তমান যুগে এই তিন দেবতার মধ্যে বিষ্ণু এবং শিবের পূজা বহুরূপে করা হলেও ব্রহ্মার আরাধনা সে তুলনায় অপ্রতুল। এই পটভূমিতে ব্রহ্মতেজের উৎস হতে সৃষ্ট বাংলাদেশের মহাতীর্থ লাঙ্গলবন্দকে এক ব্যতিক্রমী আধ্যাত্মিক ক্ষেত্ররূপে স্বীকার করতে হবে।

ধর্মীয় পুণ্যস্থানসমূহকে ছোট, বড়, মাঝারি ইত্যাদি বিশেষণে আখ্যায়িত করে তুলনা করা অনুচিত। অবশ্য কোনোরকম তুলনা বা তারতম্য না করেও দ্ব্যর্থহীন ভাবে বলা যায় যে, হিন্দু পুরাণ অনুসারে লাঙ্গলবন্দ তীর্থস্থান হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

'ওঁ ব্রহ্মপুত্র মহাভাগ শান্তনো: কুলনন্দন।

অমোঘাগর্ভসম্ভূত পাপং লৌহিত্য মে হর'

হে মহাভাগ ব্রহ্মপুত্র! তুমি শান্তনু মুণির কুলতিলক, তুমি অমোঘা দেবীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছ। হে লৌহিত্য, তুমি আমার পাপ হরণ কর। উপরিউক্ত শ্লোক জলে নেমে উচ্চারণ করে নিজ নিজ ইচ্ছা অনুযায়ী ফুল, বেলপাতা, ধান, দূর্বা, হরীতকী, ডাব, আমের পলস্নব প্রভৃতি দিয়ে তপর্ণপূর্বক ব্রহ্মপুত্র স্নানে সব পাপমুক্ত হয়ে আশাতীত পুণ্য অর্জন হয়। আর এ পুণ্য অর্জন করতে দেশ-বিদেশের হাজারো পুণ্যার্থী আসেন লাঙ্গলবন্দ তীর্থে।

কিংবদন্তি অনুযায়ী- ত্রেতাযুগের সূচনাকালে মগধরাজ্যে ভাগীরথীর উপনদী কৌশিকীর তীরঘেঁষে এক সমৃদ্ধ নগরী ছিল, যার নাম ছিল ভোজকোট। এই নগরীতে গাধি নামে চন্দ্রবংশীয় একজন রাজা ছিলেন। গাধির ছিল এক ছেলে বিশ্বমিত্র ও মেয়ে সত্যবতী। সত্যবতী বয়ঃপ্রাপ্ত হলে ভৃগুবংশীয় এক ব্রাহ্মণ সন্তান রিচিকের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। এরপর সত্যবতীর গর্ভে জমদগ্নি নামে এক পুত্রের জন্ম হয়। এই জমদগ্নি ঋষিত্ব লাভ করেন। ঋষি জমদগ্নির পাঁচ পুত্রের মধ্যে পরশুরাম ছিলেন সবার ছোট। পরশুরামের জন্মের সময় পাপভারে আক্রান্ত পৃথিবী রসাতলে যাওয়ার উপক্রম হয়। এহেন দুর্যোগময় মুহূর্তে পৃথিবীকে কলুষমুক্ত করতে নারায়ণের অংশ হিসেবে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন পরশুরাম। তিনি ছিলেন বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার। ছোটবেলা তার নাম রাখা হয়েছিল রাম। পরে ক্ষত্রীয় নিধনকল্পে হাতে পরশু বা কুঠার তুলে নিয়েছিলেন বলে তিনি পরশুরাম নামে খ্যাতিলাভ করেন।

একদিন পরশুরামের মা রেণুকাদেবী জল আনতে গঙ্গাতীরে যান। সেখানে পদ্মমালি (মতান্তরে চিত্ররথ) নামক গন্ধর্বরাজ স্ত্রীসহ জলবিহার করছিলেন (মতান্তরে অপ্সরীগণসহ)। পদ্মমালির রূপ এবং তাদের সমবেত জলবিহারের দৃশ্য রেণুকাদেবীকে এমনভাবে মোহিত করে যে তিনি তন্ময় হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকেন। অন্যদিকে, ঋষি জমদগ্নির হোমবেলা পেরিয়ে যাচ্ছে সেদিকে তার মোটেও খেয়াল নেই। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে রেণুকাদেবী কলস ভরে জল নিয়ে ঋষি জমদগ্নির সামনে হাতজোড় করে দাঁড়ান। তপোবলে ঋষি জমদগ্নি সবকিছু জানতে পেরে রেগে গিয়ে ছেলেদের মাতৃহত্যার আদেশ দেন। প্রথম চার ছেলে মাকে হত্যা করতে অস্বীকৃতি জানান। কিন্তু পরশুরাম পিতার আদেশে মা এবং আদেশ পালন না করা ভাইদের কুঠার দিয়ে হত্যা করেন। পরবর্তী সময়ে পিতা খুশি হয়ে বর দিতে চাইলে তিনি মা এবং ভাইদের প্রাণ ফিরে চান। তাতেই রাজি হন ঋষি জমদগ্নি। কিন্তু মাতৃহত্যার পাপে পরশুরামের হাতে কুঠার লেগেই রইল। শত চেষ্টা করেও সে কুঠার খসাতে পারলেন না। পিতার কাছে জিজ্ঞাসা করলেন তার পাপ মুক্তির উপায়ের কথা। পিতা বললেন, তুমি মাতৃহত্যা ও স্ত্রীলোক হত্যা এই দুই পাপে আক্রান্ত হয়েছ, তাই তোমাকে তীর্থে তীর্থে ঘুরতে হবে, যে তীর্থের জলের স্পর্শে তোমার হাতের কুঠার খসে যাবে; মনে রাখবে সেই তীর্থই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম স্থান। পিতার কথামতো পরশুরাম তীর্থে তীর্থে ঘুরতে লাগলেন। শেষে ভারতবর্ষের সব তীর্থ ঘুরে ব্রহ্মকুন্ডের পুণ্য জলে স্নান করে তার হাতের কুঠার খসে গেল। পরশুরাম মনে মনে ভাবলেন এই পুণ্য বারিধারা সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দিলে মানুষ খুব উপকৃত হবে। তাই তিনি হাতের খসে যাওয়া কুঠারকে লাঙ্গলে রূপান্তারিত করে পাথর কেটে হিমালয়ের পাদদেশ থেকে মর্তলোকের সমভূমিতে সেই জলধারা নিয়ে আসেন। লাঙ্গল দিয়ে সমভূমির বুক চিরে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হন। ক্রমাগত ভূমি কর্ষণজনিত শ্রমে পরশুরাম ক্লান্ত হয়ে পড়েন এবং বর্তমান নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্দর থানার অন্তর্গত সোনারগাঁয়ে এসে তিনি লাঙ্গল চালানো বন্ধ করেন। এজন্য এ স্থানের নাম হয় লাঙ্গলবন্দ। এরপর এই জলধারা কোমল মাটির বুক চিরে ধলেশ্বরী নদীর সঙ্গে মিশেছে। পরবর্তী সময়ে এই মিলিত ধারা বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়েছে। বর্তমানে ক্ষীণকায়, অগভীর, শেওলায় ভরা হলেও এককালে ব্রহ্মপুত্রই ছিল পৃথিবীর বড় নদগুলোর মধ্যে অন্যতম। তিব্বতের মানস সরোবরের কাছাকাছি ব্রহ্মকুন্ড থেকে এ নদের জন্ম। ব্রহ্মকুন্ডের অবস্থান স্থল প্রাচীনকালে ব্রহ্মদেশের (বর্তমান মায়ানমার) অংশ ছিল। তিব্বতে এই নদী সম্পু নামে পরিচিত। সম্পু অর্থ পবিত্র। সম্পু ভারতের আসাম রাজ্যের উত্তর-পূর্ব কোণে ৫০০ বছর আগে শ্রীশ্রীচৈতন্য দেব লাঙ্গলবন্দে এসে তর্পণ করেছিলেন- যার প্রমাণ মেলে ময়মনসিংহে প্রাপ্ত বৈদ্যরঘুনাথ দাস কৃত 'স্বরূপ চরিত' গ্রন্থে। ১৯০১ খ্রি. ২৭ মার্চ স্বামী বিবেকানন্দ তার আত্মীয়পরিজন ও শিষ্যদের নিয়ে লাঙ্গলবন্দের পুণ্যতিথিতে রাজঘাটে স্নান করেছিলেন। এই রাজঘাটেই নেপালের রাজারা স্নান করতেন বলে কোনো কোনো বইতে উলেস্নখ আছে। এছাড়া ভারতের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীর চিতাভস্ম গান্ধীঘাট মহাশ্মশানে রাখা আছে এবং লাঙ্গলবন্দে ব্রহ্মপুত্র নদে চিতাভস্ম বিসর্জন দেয়া হয়েছে- যার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৪৮ সালের ১৪ ফেব্রম্নয়ারি ঢাকা থেকে প্রকাশিত 'দৈনিক আজাদ' পত্রিকাতে।

বসন্তকালে অনুষ্ঠিত আদি দুর্গা পূজা বাসন্তী পূজা নামে পরিচিত। এই বাসন্তী পূজার অষ্টমী তিথি তথা আশোকাষ্টমীতে পুণ্যস্নান হয় মহাতীর্থ লাঙ্গলবন্দে। বিষ্ণুর অবতার পরশুরাম মাতৃহত্যার দায়মুক্ত হয়েছিলেন শিবের ঘরনি মা দুর্গার আরাধনার জন্য নির্ধারিত শুক্লাষ্টমী তিথিতে ব্রহ্মপুত্রে অবগাহন করে। এটা যেন ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের একাত্মতার প্রতীক। ধর্মের এ সব জটিল রহস্য অনুধাবন করা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের পক্ষে কঠিন। তবে সনাতন ধর্মের আদি যোগসূত্রের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশের লাঙ্গলবন্দে ঘটেছিল- যার ঐতিহ্য পরম্পরা এখনো লাখো মানুষের অংশগ্রহণে জীবন্ত, তা এ দেশের প্রতিটি মানুষের জন্য পরম সন্তোষের এবং অত্যন্ত গৌরবের বিষয়।

\হ

তারাপদ আচার্য্য : সাধারণ সম্পাদক, সাধু নাগ মহাশয় আশ্রম, দেওভোগ, নারায়ণগঞ্জ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে