সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

ব্যাংক থেকে লুটপাট হয়েছে ৯২ হাজার কোটি টাকা

প্রেস ব্রিফিংয়ে সিপিডি
যাযাদি ডেস্ক
  ২৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০

দেশের ব্যাংক খাত থেকে ২০০৮ থেকে ২০২৩-এ ১৫ বছরে অনিয়মের মাধ্যমে ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে। ব্যাংক খাত থেকে অনিয়মের মাধ্যমে বের করে নেওয়া এ অর্থ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের ১২ শতাংশের বেশি।

শনিবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত 'অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা পর্যালোচনা' বিষয়ক এক ব্রিফিংয়ে এ চিত্র তুলে ধরেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। আর সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান, গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান প্রমুখ।

সিপিডি বলছে, সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে ২৪টি ছোট-বড় অনিয়মের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে এসব অর্থ বের করে নেওয়া হয়েছে। দেশের মূলধারার বিভিন্ন গণমাধ্যমে ব্যাংক খাতের অনিয়ম নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে এ তথ্য তুলে ধরেছে সংস্থাটি।

সিপিডির পক্ষ থেকে বলা হয়, ২০০৮ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে ব্যাংক খাতের সূচকগুলোর অবনমন হচ্ছে। খেলাপি ঋণের পাশাপাশি

অন্যান্য সূচকে অবস্থার অবনতি হচ্ছে। গত ১৫ বছরের ব্যাংক থেকে যে অর্থ বের করে নেওয়া হয়েছে, তা বর্তমান মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ।

পরে এক সাংবাদিক জানতে চান, ব্যাংক থেকে যে অর্থ লুট করা হয়েছে, তার কতটা অর্থনীতিতে যুক্ত হয়েছে, আর কতটা পাচার হয়েছে? জবাবে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক বলেন, 'এ বিষয়ে আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক এসব বিষয়ে কোনো তথ্য প্রকাশও করে না। তবে ধারণা করা যায়, এ অর্থের একটি অংশ পাচার হয়েছে, কিছু অংশ হয়তো অর্থনীতিতে যুক্ত হয়েছে।'

বর্তমানে ব্যাংক খাত বৈকল্য অবস্থায় রয়েছে বলে মন্তব্য করেছে সিপিডি। সংস্থাটির গবেষণা পরিচালক বলেন, অর্থনীতি ক্রমে ভঙ্গুর থেকে ভঙ্গুরতা হচ্ছে। অর্থনীতির চার খাতের মধ্যে ব্যাংক খাত বৈকল্য দশায় পড়েছে। মূল্যস্ফীতির পাগলা ঘোড়া ছুটে চলা অব্যাহত রয়েছে, বহিঃখাত পঙ্গুত্বের ভেতরে পড়ছে আর শ্রম খাতে অন্ধত্ব বা স্থবিরতা বিরাজ করছে।

সিপিডি বলছে, দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি এখন বড় ধরনের চাপ বা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। অতীতে অর্থনীতিতে এত ধরনের চাপ কখনো তৈরি হয়নি। রাজনৈতিক নেতৃত্বের সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা। এ জন্য বড় ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক সংস্থার দরকার। এ ধরনের সংস্কারের জন্য যে রাজনৈতিক ও নির্বাচনব্যবস্থা দরকার, সেটি দেখা যাচ্ছে না। ফলে নির্বাচনের পরও অর্থনীতিতে কোনো সংস্কার হবে কি না, এটি প্রশ্নসাপেক্ষ।

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, দেশের ব্যাংক খাত এখন ব্যক্তিস্বার্থের হাতে কুক্ষিগত হয়ে গেছে। এ কারণে এই খাতে সংকট আরও বাড়ছে। যারা এ খাত থেকে বড় বড় ঋণ নিচ্ছে, তারাই আবার ঋণ পুনঃ তফসিলের নানা নিয়মকানুন তৈরিতে প্রভাব বিস্তার করছে। শুধু ব্যাংক খাত নয়, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এখন স্বার্থান্বেষী মহলের হাতে জিম্মি। ফলে এসব খাতে কতটা সংস্কার করা যাবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, 'ব্যাংকে টাকা রাখে সাধারণ জনগণ। সেই টাকা কীভাবে ব্যবহার হচ্ছে তা দেখার দায়িত্ব আমাদেরও। জনগণের অধিকার রয়েছে তা জানার। একটি শ্রেণি ব্যাংকিং খাতকে ব্যবহার করে একের পর এক ঋণ অনিয়ম করছে। বাংলাদেশ ব্যাংককে শক্তিশালী করতে জরুরি হয়ে পড়েছে অস্থায়ী ভিত্তিতে ব্যাংকিং কমিশন গঠন করা। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম-কানুনের অভাব নেই। কিন্তু এখন যারা অনিয়ম করে ঋণ নিচ্ছে, তারাই আবার বাংলাদেশ ব্যাংকে নীতিমালা করার জন্য চাপ দেয়। এজন্য শক্তিশালী কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রয়োজন।'

ব্যাংক ও আর্থিক খাতে নানা সমস্যার কথা তুলে ধরে ফাহমিদা খাতুন বলেন, 'বর্তমানে দেশে বিরাজমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি, সরকারি অর্থায়ন, ব্যাংকিং খাত, বিদেশি অর্থায়ন ও ঋণ বৈদেশিক ঋণ ব্যবস্থাপনা এবং শ্রম অধিকার ইসু্য নিয়ে নানা রকম সমস্যা বিরাজ করছে। আমাদের মূল্যস্ফীতি আমদানি পণ্যের কারণে বলা হলেও আসলে বিদেশে পণ্যের দাম কমলে দেশে কমছে না। রাজস্ব আহরণ বাড়াতে নানা রকম উদ্যোগ নেওয়া হলেও এখনো পর্যন্ত সম্পদ কর এবং ডিজিটাল ইকোনমি করের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। ব্যাংকিং খাতের মন্দ ঋণ বন্ধ করতে নানা রকম উদ্যোগের কথা শুনা গেলেও কার্যকর কিছু করা হয়নি।'

তিনি আরও বলেন, 'আমাদের অর্থনীতির এই ক্রান্তিকাল পার হওয়ার জন্য যথাযথ সংস্কার দরকার এবং পদক্ষেপ অবশ্যই রাজনৈতিক পর্যায় থেকেই আসতে হবে। এজন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার।'

বিভিন্ন ঋণ খেলাপির ঘটনায় বিশাল পরিমাণ এই অর্থ বেরিয়ে গেলেও এর বিপরীতে 'যৎসামান্য' অর্থ আদায় হয়েছে জানিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে 'শক্তিশালী' করার ওপর জোর দেন ফাহমিদা।

কোথায় কত গেছে

সিপিডির হিসাবে, রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালি ব্যাংকের হলমার্ক গ্রম্নপ নিয়ে গেছে ৪ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা। জনতা, প্রাইম, যমুনা, শাহজালাল ও প্রিমিয়ার ব্যাংক থেকে বিসমিলস্নাহ গ্রম্নপ নিয়ে গেছে ১ হাজার ১৭৪ কোটি ৪৬ লাখ টাকা।

\হবেসিক ব্যাংক থেকে ২০১৫ সালে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার ঋণ নেওয়া হয় জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এ ঘটনায় ৬০টি মামলা করেছে ১২০ জনের বিরুদ্ধে। এননটেক্স জালিয়াতির মাধ্যমে জনতা ব্যাংক থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়েছে। এই অর্থ ব্যাংকটির মোট মূলধনের ২৫ শতাংশ।

২০১৬ সালে থার্মেক্স গ্রম্নপ এলসি জালিয়াতির মাধ্যমে জনতা ব্যাংক থেকে ৮১৬ কোটি টাকা ঋণ নেয়, যদিও জনতা ব্যাংকে ওই কোম্পানির ঋণ সীমা ছিল ২৬৪ কোটি টাকা। জনতা ব্যাংক থেকে ২০২০ সালে ঋণ সীমা লঙ্ঘন করে এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ ১ হাজার ২৪৮ কোটি টাকা এবং ২০২৩ সালে গেস্নাবাল ট্রেডিং ১ হাজার ৭০ কোটি টাকা ঋণ নেয়।

এবি ব্যাংকে ১৬৫ কোটি টাকার মানিলন্ডারিংয়ের ঘটনায় ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ও কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ত করে দুদক মামলা করেছে। গেস্নাবাল ইসলামী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক পিকে হালদার ২০২১ সালে ৩ হাজার কোটি টাকার ঋণ অনিয়ম করেন। এ ঘটনায় দুদক ৩৭টি মামলা করেছে তার বিরুদ্ধে।

এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকে ২০১৬ সালে ৭০১ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয় অনিয়মের মাধ্যমে। ইসলামী ব্যাংক থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে এস আলম গ্রম্নপ বেনামি কোম্পানির মাধ্যমে। এ বিষয়ে ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে ঋণ অনিয়মের অনুসন্ধানের জন্য উচ্চ আদালতে পিটিশন দাখিল করেন এক আইনজীবী।

ইসলামী ব্যাংকে ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে অপরিচিত নয়টি কোম্পানিকে নিয়ম লঙ্ঘন করে ৭ হাজার ২৪৬ কোটি টাকার ? দেওয়া হয়। মিথ্যা তথ্যে রাজশাহীর নাবিল গ্রম্নপের বিভিন্ন কোম্পানিকে এই ঋণ দেওয়া হয়। এছাড়া ভুয়া কোম্পানিকে ২ হাজার ৩২০ কোটি টাকার ঋণ দেয় সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক। অনিয়ম-খেলাপির প্রধান এই ঘটনাগুলোর বাইরেও অনেক ঋণ খেলাপির ঘটনা রয়েছে।

সিপিডির ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'খেলাপি ঋণের যে তথ্য প্রকাশ করা হয়, তা পুরোটা নয়। ১০ বছর আগে খেলাপির পরিমাণ ৪২ হাজার ৭২৫ কোটি টাকা থাকলেও সবশেষ গত সেপ্টেম্বর শেষে তা ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা ছাড়ায়।' এছাড়া ঋণ পুনঃতফসিল, মামলার কারণে খেলাপি দেখাতে না পারা ও অবলোপন করা খেলাপি ঋণের তথ্য দেখানো হয় না বলে জানান তিনি।

তিনি আরও বলেন, 'উচ্চ মূল্যস্ফীতি কারণে দেশে বৈষম্য আরও প্রকট হচ্ছে। এতে আমরা আবারও এক দেশে দুই অর্থনীতির পথে চলে যাচ্ছি। অথচ দুই অর্থনীতির বিরুদ্ধেই বঙ্গবন্ধু লড়াই-সংগ্রাম করে গেছেন। যার হাত ধরে দেশের স্বাধীনতা এসেছে। কিন্তু এখন সম্পদের বণ্টনব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে আবারও দুই সমাজ বা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠছে। এ ব্যবস্থা রোধ করতে হলে সম্পদ বণ্টনের ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে হবে।

\হকোনো প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার প্রয়োজন বলে মনে করেন- সংবাদ সম্মেলনে এ প্রশ্নে সিপিডির জ্যেষ্ঠ গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, আমার মনে হয় যে নির্বাচন পরবর্তী সময়ে অর্থনীতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার।

তিনি আরও বলেন, 'অন্তত ১২টি বড় প্রতিষ্ঠানের সংস্কার দরকার। যেমন- বাংলাদেশ ব্যাংক, সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন, প্রতিযোগিতা কমিশন, অর্থ মন্ত্রণালয়, শ্রম মন্ত্রণালয়, বেপজা, লেবার কোর্ট, শিল্প পুলিশ, বর্ডার গার্ডস, অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংক (এবিবি), প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে