১৯৭১ সালের ৫ আগস্ট। চুয়াডাঙ্গা জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে মর্মান্তিক ও স্মরণীয় একটি দিন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এ দিনে জেলার ৮ জন মুক্তিযোদ্ধা সম্মুখ সমরে শহীদ হন। তারা হলেন-হাসান জামান, সাইফুদ্দিন তারেক, রওশন আলম, আলাউল ইসলাম খোকন, আবুল কাশেম, রবিউল ইসলাম, কিয়ামুদ্দিন ও আফাজ উদ্দীন।
১৯৭১ সলের ৩ আগস্ট বীর মুক্তিযোদ্ধা গেরিলা গ্রম্নপ কমান্ডার হাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে একদল বীর মুক্তিযোদ্ধা দামুড়হুদা উপজেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম জগন্নাথপুর গ্রামের শেল্টার ক্যাম্পে অবস্থান করছিলেন। ৪ আগস্ট মুক্তিযোদ্ধারা পাশের বাগোয়ান গ্রামের মুসলিম লীগের দালাল কুবাদ খাঁকে ধরে নিয়ে আসে। মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি হানাদারদের উপর আক্রমণ করার পরিকল্পনা করছিল। ৫ আগস্ট সকালে পাকিস্তানি দালাল কুবাদ খাঁর দু'জন লোক মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে গিয়ে খবর দেয়, রাজাকাররা তাদের ধান কেটে নিয়ে যাচ্ছে। এ খবর শুনে মুক্তিযোদ্ধা হাসান জামানের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা রাজাকারদের শায়েস্তা করার জন্য অস্ত্র নিয়ে আনুমানিক ২ কিলোমিটার দূরে বাগোয়ান গ্রামের মাঠে দুই দলে বিভক্ত হয়ে অগ্রসর হতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের রেকি দল ফিরে যাওয়ার সাথে সাথে নাটুদহ ক্যাম্পের পাকিস্তানি সেনারা পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী মাঠের আখ ক্ষেতে 'ইউ'কাটিং অ্যাম্বুশ করে। মুক্তিযোদ্ধারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাদের অ্যাম্বুশে পড়ে যায়। এখানে পাকিস্তানি হানাদারদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রায় আড়াই ঘণ্টা যুদ্ধ হয়। পাকিস্তানি হানাদারদের কাছে থাকা আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের উপর ব্যবহার করতে থাকে। অবস্থা বেগতিক দেখে মুক্তিযোদ্ধারা কৌশলে দুটি দলে বিভক্ত হয়ে শত্রম্নকে আক্রমণ করতে থাকে। এ অবস্থায় যে কোনো একজনকে কাভারিং ফায়ার দিয়ে নিজ দলকে বাঁচাতে হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধা হাসান জামান স্বাভাবিক ফায়ারের দায়িত্ব নিয়ে শহীদ হন। পিছু হটার সময় তারা অন্য সাথীদের বাঁচাতে পারলেও শহীদ হন ৮ বীর মুক্তি সেনা। পাকিস্তানি হানাদাররা তাদেরকে ঘিরে ফেলে খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করে। এই সম্মুখযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদারদের অনেক সদস্য মারা যায় এবং আহত হয়। পরে জগন্নাথপুর গ্রামের মানুষ রাস্তার পাশে দুটি কবরে চারজন করে আটজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার লাশ কবর দেয়। কালক্রমে এই আটজন মুক্তিযোদ্ধার কবরকে ঘিরেই এ স্থানটির নামকরণ হয়েছে 'আটকবর'।
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা সোলাইমান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুনের প্রচেষ্টায় ১৯৯৮ সালে এলজিইডি'র তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী কামরুল ইসলাম সিদ্দিকীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ওই গণকবরের উপর স্মৃতিসৌধ গড়ে তোলা হয়। নাম দেওয়া হয় আটকবর।
প্রতি বছর ৫ আগস্ট স্থানীয় শহীদ দিবস হিসেবে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন কর্মসূচি পালন করে থাকে।
১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর। এদিন ভোরে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর কমান্ডার মেজর দত্ত ও বর্ম্মা এবং ৮ নম্বর সেক্টরের বানপুর সাব- সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন মোস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্র বাহিনী যৌথভাবে জীবননগরের ধোপাখালী সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে প্রবেশ করে জীবননগর, দত্তনগর, হাসাদহ সন্তোষপুর, রাজাপুর, ধোপাখালী ও মাধবখালীতে অবস্থানরত পাকিস্তানি হানাদারদের উপর অতর্কিতভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুরু হয় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। এ সময় রাজাপুর ও মাধবখালী সীমান্তে সম্মুখ সমরে শহীদ হন- হাবিলদার আব্দুল গফুর, নায়েক আব্দুল মালেক, আব্দুর রশিদ, সিপাহী সিদ্দিক আলী, আব্দুল আজিজ ও আবু বকর। যুদ্ধে পাকহানাদার বাহিনীর ২৯ বেলুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা যৌথ বাহিনীর কাছে পরাজিত হয়ে পার্শ্ববর্তী জেলা ঝিনাইদহের দিকে পালিয়ে যায়। এ সময় জীবননগর থানায় ফেলে যাওয়া পাকবাহিনীর ক্যাপ্টেন নারী ধর্ষণকারী ও অমানুষিক নির্যাতনকারী হিসেবে চিহ্নিত মুনছুর আলীর ব্যবহৃত জিপ গাড়িতে মুক্তিযোদ্ধারা আগুন ধরিয়ে দেয় এবং থানার মালখানা থেকে উদ্ধার করে পাশবিক নির্যাতনের পর হত্যা করা ৭/৮ জন অজ্ঞাত পরিচয়ের যুবতীর লাশ।
এদিকে, ধোপাখালী ও মাধবখালীতে সংঘটিত যুদ্ধে শহীদ ছয়জনই ছিলেন ইপিআর সদস্য। তাদের কবর রয়েছে চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলার মাধবখালি সীমান্তে। এই স্মৃতি সংরক্ষণে ১৪ লাখ ৯৭ হাজার ৫৮০ টাকা ব্যয়ে মাধবখালিতে ওই ৬ বীর মুক্তিযোদ্ধার সমাধি সংরক্ষণ ও পুনঃনির্মাণ কাজ শুরু করে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর। প্রায় অর্ধেক কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর বাধা দেয় বিএসএফ। বন্ধ হয়ে যায় কাজ।
এলাকাবাসীর দাবি, সরকার যেন ভারতের সাথে আলোচনা করে অসমাপ্ত কাজটি সমাপ্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করে।
অন্যদিকে, স্বাধীনতার ৪৯ বছর পর এই প্রথম ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)'র পক্ষ থেকে এই ছয় বীর মুক্তিযোদ্ধার সমাধিতে গত ১৬ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে শ্রদ্ধাঞ্জলী জানানো হয়। সেদিন বিএসএফ'র ৫৪ সীমানগর ব্যাটালিয়নের কমান্ড্যান্ট দেবরাজ সিং বলেন, অবশ্যই উচ্চ পর্যায়ে আলোচনার মাধ্যমে স্মরণীয় এ সমাধি সংরক্ষণের কাজ সমাপ্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
এ ব্যাপারে বিজিবির ৫৮ মহেশপুর ব্যাটালিয়নের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল কামরুল আহসান বলেন, বিএসএফ'র সাথে আলোচনা হয়েছে। তারা নকশায় একটু পরিবর্তন এনে কাজটি সম্পন্ন করার ব্যাপারে সম্মত হয়েছে। বিজিবির পক্ষ থেকেও সব ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
একাত্তরের ৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় পাকিস্তানি হানাদাররা চুয়াডাঙ্গা শহরমুখী মাথাভাঙ্গা নদীর ব্রিজের একাংশ শক্তিশালী বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে উড়িয়ে দেয়। যাতে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের অনুসরণ করতে না পারে। ৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় পাকিস্তানি হানাদাররা চুয়াডাঙ্গা শহর ও আলমডাঙ্গা অতিক্রম করে কুষ্টিয়ার দিকে চলে যায়।
এ দিন বীর মুক্তিযোদ্ধারা চুয়াডাঙ্গার মাটিতে প্রথম উত্তোলন করে স্বাধীন বাংলার লাল-সবুজ পতাকা। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর চুয়াডাঙ্গাকে মুক্ত করে এ জেলার বীর মুক্তিযোদ্ধারা।
চুয়াডাঙ্গায় মোট মুক্তিযোদ্ধা ১৬শ ৩১ জন। তাদের মধ্যে যুদ্ধাহত ১৫৬ জন। এ রণাঙ্গনে শহীদ হয়েছেন ১৭ জন মুক্তিযোদ্ধা। এ জেলায় দুজন বীর প্রতীকও রয়েছেন। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে চুয়াডাঙ্গার এসব সূর্য সন্তানকে সাহসী মোকাবেলা চুয়াডাঙ্গাকে করেছে মহিমান্বিত।