শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অবহেলায় ঐতিহ্যের ধারক সেই ১৪ জমিদারবাড়ি

মো. নূরুল হক কবির, হবিগঞ্জ
  ১৯ জানুয়ারি ২০২১, ০০:০০
অযত্ন-অবহেলায় জরাজীর্ণ হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জের একটি জমিদারবাড়ি -যাযাদি

হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ উপজেলার আড়াইশ বছরের পুরনো ১৪টি জমিদার বাড়ি বর্তমানে অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে। এর মধ্যে চারটি বাড়ি স্থানীয় প্রভাবশালীদের দখলে এবং দুটি নতুনভাবে সংস্কার করে ব্যবহার করছে দখলদাররা। এ ছাড়া বাকি বাড়িগুলোর অবস্থা একেবারেই জরাজীর্ণ হওয়ায় এগুলো পরিণত হয়েছে মাদকসেবী ও জুয়াড়িদের অভয়াশ্রমে। সরেজমিন জানা যায়, জেলার আজমিরীগঞ্জ উপজেলার জলুসখা গ্রামে ছিল ১৪ জন জমিদারের বাস। তাদের মধ্যে ১৩ জন জমিদার ছিলেন সনাতন ধর্মাবলম্বী এবং বাকি একজন মুসলিম। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ দ্বিখন্ডিত হওয়ার পর অধিকাংশ জমিদারই চলে যান ভারতে। তাদের উত্তরসূরিরা ভারত এবং কেউ কেউ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে বাস করছেন।

জলসুখা গ্রামের দলিল লেখক তাজদিকুল ইসলামের কাছে সংরক্ষিত তালিকা অনুযায়ী, জমিদাররা হলেন চন্দ্র কুমার রায়, কৃষ্ণ কুমার রায়, সূর্যমনি রায়, বৈকুণ্ঠ নাথ রায়, শরৎ চন্দ্র রায়, ভারত চন্দ্র রায়, নন্দলাল রায়, গোবিন চন্দ্র রায়, সতীশ কুমার রায়, লক্ষ্ণীকান্ত রায়, ক্ষেত্রনাথ রায়, মাধব চন্দ্র রায়, রমা বলস্নব হালদার ও রমজান আলী চৌধুরী ওরফে বুছা মিয়া চৌধুরী। তারা একেকজন ছিলেন একেক তালস্নুক বা চৌহদ্দির খাজনা আদায়ের দায়িত্বে।

তাজদিকুল ইসলাম যায়যায়দিনকে জানান, জমিদার সতীশ কুমার রায় ছিলেন অখন্ড ভারতবর্ষের শিক্ষা বোর্ডের ডিরেক্টর। তার ভাই মাধব চন্দ্র রায় ছিলেন আরসিসির জনক। এ ছাড়া জমিদার প্রতাপ সিংহ রায়ের ছেলে সতীশ চন্দ্র রায় ছিলেন অখন্ড ভারতবর্ষের একজন খনিজবিদ্যা বিশারদ। তার জানা তথ্য মতে, অধিকাংশ জমিদারই ছিলেন শিক্ষানুরাগী। তাদের মধ্যে জমিদার চন্দ্র কুমার রায় ১৮৭৬ সালে 'কৃষ্ণ গোবিন্দ উচ্চবিদ্যালয়' নামে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

সরেজমিন জলসুখা গ্রামের দক্ষিণ পাড়ায় দেখা যায়, জরাজীর্ণ একটি ভবন। তার নাম ছিল আটচালা। স্থানীয়দের বিবরণ অনুযায়ী, এই ভবনটির মালিক ছিলেন জমিদার গোবিন চন্দ্র রায়। ১৪ জমিদারের সবার চেয়ে বেশি ক্ষমতাধর ছিলেন তিনি। আটচালা ভবনটিতে বৈঠক করতেন ১৪ জমিদার। ভবনটি বর্তমানে একেবারেই অরক্ষিত। সন্ধ্যার পরপরই সেখানে জুয়াড় আসর বসে বলে জানান স্থানীয়রা। তবে বর্তমানে এই বাড়িটির একটি কক্ষে রয়েছে সরকারি ভূমি অফিস।

কথা হয় জরাজীর্ণ একটি মহলে থাকা জমিদার পরিবারের এক বংশধর কমলেশ রায়ের সঙ্গে। তার দাদা ক্ষেত্রনাথ রায় ছিলেন ১৪ জমিদারের একজন। ৮৫ বছর বয়সি কমলেশ আক্ষেপ করে জানান, তার বাবা ক্ষিতিশ রায় জমিদারির কিছুটা ভোগ করতে পারলেও তার জন্ম জমিদারির শেষ সময়। অন্য জমিদাররা ভারতে চলে গেলেও তার পরিবার যায়নি। বংশধরদের মধ্যে যারা ভারতে চলে গিয়েছিলেন, অধিকাংশরাই বাড়ির কাজের লোকদের বিশ্বাস করে সবকিছু আমানত রেখে যান। কিন্তু ফিরে এসে দেখেন, সব দখল হয়ে গেছে। এর মধ্যে কয়েকটি বাড়িতে এখনো ওইসব কাজের লোকের প্রজন্মরা বসবাস করছেন। আর কয়েকটি রয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালীদের দখলে।

কমলেশ আরও জানান, তার দাদার ব্যবহৃত ভবনটি এখনো তাদের দখলে থাকলেও নেই জমিদারির কোনো নিশানা। অভাবের তাড়নায় বিক্রি করে দিয়েছেন জমিদারদের ব্যবহৃত বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী জিনিসপত্র। কিছু জিনিসপত্র অনেক কষ্টে আঁকড়ে ধরে রাখলেও সময়ের ব্যবধানে সেগুুলোও চুরি হয়ে গেছে।

জলসুখা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান জানান, জমিদাররা ভারতে চলে যাওয়ার পর স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মদদে অনেকেই ভুয়া ওয়ারিশান সদনপত্র তৈরি করে জমিজমার কাগজ নিজের নামে করিয়ে নিয়েছেন। ওই জমিজমার দখলদার অনেকেই এখন কোটিপতি হিসেবে এলাকায় পরিচিত।

জলসুখা গ্রামের হাজি আবদুল হাশিম জানান, ১৮ শতকের কোনো এক সময় জমিদার বৈকুণ্ঠ রায়ের বাবা দুলগোবিন্দ রায়ের বাড়িতে লর্ড ক্লাইভ এসেছিলেন। এখানে এক রাত যাপন করেছিলেন তিনি। তখনকার সময়ই তার আপ্যায়নে এক লাখ টাকা ব্যয় করেছিলেন দুলগোবিন্দ রায়। জানা যায়, এই জমিদার বাড়িটিতে সে সময় ঘেটু নৃত্য পরিবেশিত হতো।

মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক গবেষক ও সাবেক উপসচিব ড. শেখ ফজলে এলাহী জানান, জলসুখা এলাকায় ১৪ জন জমিদারের বাস ছিল; এটা ঠিক। এর মধ্যে দুই-একজন ছিলেন খুব প্রভাবশালী।

স্থানীয় ওয়ারিশ মিয়া নামে একজন বলেন, অনেকদিন আগে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এই জমিদার বাড়ি দেখতে ভিড় করতেন পর্যটকরা। কিন্তু কয়েক বছর ধরে এগুলো একেবারেই অরক্ষিত হয়ে গেছে। তাই বাড়িগুলো দেখতে আর কেউ আসেন না। তিনি আরও বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে এই জমিদার বাড়িগুলোকে সংরক্ষণ করা হলে আবারও ফিরে পাবে পুরনো আকর্ষণ। জমিদারদের ব্যবহৃত এই ভবনগুলোকে সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় সচেতন মহল।

এ ব্যাপারে আজমিরীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মতিউর রহমান খান বলেন, সম্প্রতি তিনি এখানে যোগদান করেছেন। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সরেজমিন পরিদর্শন করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাবেন তিনি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে