শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশে সবকিছুর মূল্যই কেবল বৃদ্ধি পায়

নতুনধারা
  ০৭ জুলাই ২০১৯, ০০:০০

২০১৭ সালে সরকার গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়। কিন্তু তখন গণশুনানিতে অংশ নেয়া ভোক্তা অধিকার প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধিরা যুক্তি দেখান যে ৫টি সরকারি গ্যাস কোম্পানির সবগুলো লাভজনক পর্যায়ে আছে, কিন্তু তারপরও কেন গ্যাসের দাম বাড়ানো হবে? সে ব্যাপারে গ্যাস কোম্পানিগুলো কোনো যুক্তি দিতে না পারলেও গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়। কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এ ব্যাপারে উচ্ছ আদালতে রিট করলে উচ্চ আদালতের নির্দেশে সে যাত্রার মূল্যবৃদ্ধি প্রক্রিয়া স্থগিত হয়ে যায়। এরপর গত বছর সরকার আবার দাম বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়। সে সময় বড় যুক্তি হিসেবে দেখানো হয় আমদানিকৃত এলএনজির সঙ্গে দাম সমন্বয়ের বিষয়টা। তখন গণশুনানিতে অংশ নিয়ে ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. শামসুল আলম কীভাবে সিস্টেম লস কমিয়ে এলএনজির সঙ্গে মূল্য সমন্বয় করা যায় তা দেখিয়ে দিয়েছিলেন। শক্ত যুক্তি এবং সামনে নির্বাচন থাকায় সরকার তখনও পিছিয়ে যায়। গ্যাসের দাম বাড়লে দেশে পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাবে, সেই সঙ্গে বাড়বে বিদ্যুৎ ব্যয়। ফলে অনিবার্যভাবে দেখা দেবে মূল্যস্ফীতি, যা জনজীবনকে আরও সংকটে ফেলবে। সুতরাং আর মূল্য বৃদ্ধি নয়, আর যদি বাড়াতেই হয়। ২-৩ সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ হারে বাড়ানো হোক। অতীতের মতো শতভাগ বা ৪০-৫০ শতাংশ অবশ্যই নয়। রাজধানীতে চলাচলকারী সিটিং সার্ভিস বাসে বেশি ভাড়া নেয়া হচ্ছে। এতে সাধারণ মাছুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে ক্ষোভ। রাজধানীর মিরপুর-মতিঝিল রুটে চলাচল করে ট্রান্সসিলভা পরিবহনের সিটিং সার্ভিস বাসগুলো। ওঠার পর যাত্রী যেখানে খুশি নামতে পারেন, তবে এজন্য নূ্যনতম ভাড়া দিতে হয় ২০ টাকা। তবে শেষ গন্তব্য পর্যন্ত ভাড়া ৩০ টাকা। একই পথে চলাচলকারী অন্য পরিবহনের সিটিং সার্ভিস বাসগুলোর ক্ষেত্রেও একই নিয়ম চালু রয়েছে। ভাড়ার হারও অভিন্ন। তবে সিএনজির দাম বৃদ্ধির ঘোষণার পর থেকে যাত্রীদের কাছ থেকে এসব বাসে নূ্যনতম ভাড়া আদায় করা হয়েছে ২৫ টাকা। মিরপুর-১ থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ভাড়া নেয়া হয়েছে ৩৫ টাকা। এ নিয়ে বিভিন্ন গন্তব্যের যাত্রীদের সঙ্গে গণপরিবহনের উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়, এমনকি ছোটখাটো হাতাহাতির ঘটনাও ঘটে। গণপরিবহন শ্রমিকদের দাবি, গ্যাসের দাম বাড়ায় জ্বালানি খরচ বেড়েছে। এ কারণে যাত্রীদের কাছ থেকে বেশি ভাড়া নিতে হচ্ছে। মালিকের সঙ্গে চুক্তিভিত্তিতে গাড়ি চালানোর কারণে বাড়তি ভাড়া না নিলে এ লোকসান তাদের বহন করতে হবে। তবে সড়ক পরিবহন সূত্রগুলো জানায়, গ্যাসের দাম বাড়ার পর বাস-মিনিবাস ও অটোরিকশার ভাড়া বাড়বে কিনা, বাড়লে কত বাড়বে, তা এখনো নির্ধারণ করে দেয়া হয়নি। ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতিও ভাড়ার হার নির্ধারণের আগে বেশি ভাড়া না নিতে বাস কোম্পানির মালিকদের নির্দেশ দিয়েছে। ভাড়া নির্ধারণের আগেই বেশি ভাড়া আদায় করা হলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। যদিও প্রশাসনের এ ধরনের হুমকি-ধমকিতে গণপরিবহনের ভাড়া নৈরাজ্যে কতটা লাগাম টানা সম্ভব হবে তা নিয়ে পরিবহন সংশ্লিষ্টরা সংশয় প্রকাশ করেছে। তাদের ভাষ্য, অতীতেও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির পর বাস-মিনিবাস ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার মালিক-চালকরা তাদের খেয়ালখুশিমতো ভাড়া বাড়িয়ে নিয়েছে। ওই সময়ও প্রশাসন নানা ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ঘোষণা দিয়ে তা নথিপত্রেই গন্ডিবদ্ধ রেখেছে। অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের পরই বলা যায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের প্রধান দুটি উপাদান হচ্ছে গ্যাস ও বিদু্যৎ। তা ছাড়া যে কোনো দেশের উন্নয়নেরও প্রধান শর্ত হচ্ছে গ্যাস ও বিদু্যৎ। আধুনিক সভ্যতার যুগে গ্যাস ও বিদু্যৎ ছাড়া একটি দিনও কল্পনা করা যায় না। শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠার জন্য অপরিহার্য উপাদান এই গ্যাস ও বিদু্যৎ। মোদ্দাকথা, গ্যাস-বিদু্যৎ ছাড়া যে কোনো দেশ নিমিষেই অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে। রান্না ঘরের গ্যাসের চুলার বিল ৭৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯২৫ টাকা করা হয়েছে। আর যারা ৮০০ টাকা বিল দিতেন তাদের দিতে হবে ৯৭৫ টাকা। আবাসিক এবং বাণিজ্যিক সব ধরনের গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে বিইআরসি। ৩০ জুন হুট করে এই দাম বৃদ্ধির ঘোষণা দেয় এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। যা পহেলা জুলাই থেকে কার্যকর হয়ে গেছে। গ্যাসের এই দাম বৃদ্ধি যৌক্তিক হলো না। কারণ গ্যাসের দাম বৃদ্ধি নিয়ে যে গণশুনানির আয়োজন করেছিল বিইআরসি, সে ব্যাপারে উচ্চ আদালতে রিট হয়েছে। ওই রিটের ব্যাপারে চূড়ান্ত কোনো নির্দেশ না হওয়ার পরও গ্যাসের দাম বৃদ্ধি নিয়মতান্ত্রিক হলো না। বিষয়টা বিইআরসিকে ভাবতে হবে। গ্যাসের দাম বৃদ্ধির জন্য নানামুখী তৎপরতা চালাচ্ছে বিইআরসি অনেক দিন ধরে। কিন্তু দাম বৃদ্ধির পক্ষে শক্ত কোনো যুক্তি না থাকায় তারা তা করে উঠতে পারছিল না। এর আগের বার গণশুনানিতে জানা যায়, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ৫টি গ্যাস কোম্পানির সব লাভজনক পর্যায়ে আছে। আইন অনুযায়ী কোম্পানি লাভে থাকলে দাম বাড়াতে পারে না। সুতরাং সে যাত্রায় উচ্চ আদালতের নির্দেশে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির প্রচেষ্টা স্থগিত হয়ে যায়। এবারও পরিস্থিতি একই রকম আছে। বর্তমানে শুধু সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি ছাড়া বাকি ৫টি বিতরণ কোম্পানি লাভে আছে। একমাত্র সঞ্চালন কোম্পানি জিটিসিএলও লাভে আছে। কিন্তু এরপরও সরকার আমদানিকৃত এলএনজির দামের সঙ্গে মূল্য সমন্বয় করার অজুহাতে গ্যাসের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। যদিও কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম হিসেব করে দেখিয়ে দিয়েছেন, শুধুমাত্র সিস্টেম লস কমিয়ে এলএনজির সঙ্গে মূল্য সমন্বয় সম্ভব। কিন্তু সরকার সেদিকে না গিয়ে গ্রাহকপর্যায়ে দাম বৃদ্ধিকেই একমাত্র সমাধান হিসেবে বেছে নিল, যা যৌক্তিক হলো না। সদ্য পাস হওয়া বাজেটে, চিনি ভোজ্য তেল, মোবাইলচার্জ, তৈজসপত্র প্রভৃতির দাম বেড়ে গেছে। অন্যদিকে সঞ্চয়পত্রের আয় কমেছে। এরপর মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো বাড়ল গ্যাসের দাম। গ্যাসের দাম বৃদ্ধির কারণে শিল্পপণ্য এবং পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাবে। এটা ঠিক যে সরকারি পণ্যেরও দাম বাড়াতে হবে, না হলে সরকার চলবে কি করে! কিন্তু সেই দাম বৃদ্ধি যৌক্তিক হতে হবে আবারও গ্যাসের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। আর দাম বাড়ানোর কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এলএনজি আমদানির ফলে জ্বালানি খাতে ১৮ হাজার ২৭০ কোটি টাকার ঘাটতি মেটাতেই এ সিদ্ধান্ত। ঘোষণা অনুযায়ী অর্থবছরের প্রথম দিন ১ জুলাই থেকে মূল্যবৃদ্ধি কার্যকর হবে। আর দাম বৃদ্ধির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩২ দশমিক ৮ শতাংশ। ভোক্তা থেকে শুরু করে সর্বস্তরের জনগণ এবং বিশ্লেষকদের মতামত উপেক্ষা করে ঘন ঘন গ্যাসের দাম বাড়ানো হচ্ছে কাদের স্বার্থে- এমন প্রশ্নও আছে। তবে আপত্তির মুখে বিইআরসির গ্যাসের দাম বাড়ানোর সাম্প্রতিক এ সিদ্ধান্ত বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুযায়ী 'অযৌক্তিক ও অগ্রহণযোগ্য' বলেই প্রতীয়মান হয়। কেননা, গ্যাসের দাম বাড়ানোর ফলে জাতীয় অর্থনীতি ও জনগণের বৃহদাংশের জীবনযাত্রায় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা অমূলক নয়। সুতরাং গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তটি সুচিন্তিত ও যৌক্তিক হলো কিনা, তা নিয়ে চিন্তার যথেষ্ট অবকাশ থাকে। বলার অপেক্ষা রাখে না, গ্যাসের দাম বাড়ানোয় প্রথমত, শিল্প খাতের উৎপাদন-ব্যয় বাড়বে, যার আর্থিক চাপ চূড়ান্তভাবে গিয়ে পড়বে ভোক্তা সাধারণের জীবনযাত্রায়। দ্বিতীয়ত, বিদু্যৎ উৎপাদনের প্রধান জ্বালানি যেহেতু প্রাকৃতিক গ্যাস, তাই এর মূল্যবৃদ্ধির ফলে ইতিমধ্যে সমস্যাগ্রস্ত বিদু্যৎ খাতের সমস্যা আরও বাড়বে। বিদু্যতের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ার প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী: এরপর ভোক্তাপর্যায়ে বিদু্যতের দামও বাড়ানোর যুক্তি আসবে। কৃষিতে সেচের কাজে বিদু্যতের ব্যবহার বিবেচনায় নিলে কৃষকের দুর্দশা আরও বাড়ার পথই প্রসারিত হলো। আমরা জানি, গ্যাস, বিদু্যৎ ও কৃষি খাতে সরকার যথেষ্ট পরিমাণ ভর্তুকি দিয়ে থাকে। যেখানে বাংলাদেশ সরকার এত বড় বাজেট ঘোষণা করার সক্ষমতা অর্জন করেছে সেখানে এই দেশে বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম না বাড়ালেই কি নয়? ভোক্তা অধিকারের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিলে মূল্যবৃদ্ধির এই অযৌক্তিক সিদ্ধান্তের দিকে সংশ্লিষ্টদের যেতে হতো না- এমন মতও রয়েছে বিশেষজ্ঞদের। অথচ সংশ্লিষ্টরা কোনো মতামতকে কখনোই গুরুত্ব দেয়নি। জনহিতে সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ব আসলে কি- সঙ্গত কারণে এমন প্রশ্ন অযৌক্তিক হতে পারে না।

নজরুল ইসলাম লিখন

রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<56968 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1