শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রাজনৈতিক দোকানগুলো বন্ধ করা সময়ের দাবি

আওয়ামী লীগ পুরনো রাজনৈতিক দল। এ দলের কলেবর বৃদ্ধির জন্য ভুঁইফোঁড় সংগঠন, রাজনৈতিক দোকান, সুযোগ সুবিধা সন্ধানী লোকজন প্রয়োজন হতে পারে না। বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার সদস্যদের নাম ভাঙ্গিয়ে, ছবি ব্যবহার করে রাজনৈতিক দোকান খোলা এবং যে দোকানগুলো ইতোমধ্যে খোলা হয়েছে সেগুলো বন্ধের উদ্যোগ দ্রম্নত নেয়া দরকার আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধুর পরিবারের ভাবমূর্তির স্বার্থেই।
জহির চৌধুরী
  ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০

জাতীয় শোক দিবস স্মরণে ৪ সেপ্টেম্বর তাঁতী লীগ আয়োজিত স্মরণ সভায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, 'অনেকেই বঙ্গবন্ধুর ছবি টাঙিয়ে, তার নাম ভাঙ্গিয়ে রাজনীতির দোকান খুলে বসেছে। এমন কি, বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সজীব ওয়াজেদ জয়ের ছবি দিয়ে দোকান খুলেছে। বঙ্গবন্ধুর ও শেখ হাসিনার নাম ছবি ব্যবহার করে কোনো রাজনৈতিক দোকান খোলা যাবে না।' বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার সদস্যদের নাম ভাঙ্গিয়ে, ছবি টাঙিয়ে রাজনৈতিক দোকান খোলা এবং যে দোকানগুলো এরই মধ্যে খোলা হয়েছে সেগুলো বন্ধ করা এখন সময়ের দাবি। কতিপয় ধান্ধাবাজ এ সব রাজনৈতিক দোকান খুলে হেন অপকর্ম নেই যা করছে না। এদের অপকর্মে দেশের মানুষ অতিষ্ঠ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের নাম ভাঙ্গিয়ে, ছবি ব্যবহার করে এ পর্যন্ত কত সংখ্যক রাজনৈতিক দোকান খোলা হয়েছে তা সঠিকভাবে বলা কঠিন। আওয়ামী লীগের পক্ষেও তাৎক্ষণিক সঠিক সংখ্যা জানানো সম্ভব কিনা সন্দেহ আছে। চলতি বছরের মার্চ মাসে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্যমতে, গত ১০ বছরে খোলা এ ধরনের রাজনৈতিক দোকানের সংখ্যা ৪০০। এ ধরনের রাজনৈতিক দোকানের যে নামগুলো বিভিন্ন সময়ে সংবাদ মাধ্যমে এসেছে তার কয়েকটি হচ্ছে- 'বঙ্গবন্ধু আওয়ামী পরিবার লীগ', 'বাংলাদেশ আওয়ামী শিশু লীগ', 'বাংলাদেশ আওয়ামী সজীব ওয়াজেদ জয় লীগ', 'বাংলাদেশ আওয়ামী মিডিয়া লীগ', 'আলস্নাহওয়ালা লীগ', 'পর্যটন লীগ', 'তরিকত লীগ', 'বাংলাদেশ ইলেকট্রিক লীগ', 'নাপিত লীগ', 'ফকির লীগ', 'জননেত্রী লীগ', 'জননেত্রী চিন্তা লীগ', 'প্রবীণ লীগ', 'ডিজিটাল লীগ', আওয়ামী অভিভাবক লীগ', 'বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব পরিষদ', ' 'নৌকার নতুন প্রজন্ম লীগ', 'বঙ্গবন্ধুর চিন্তাধারা বাস্তবায়ন পরিষদ', 'বঙ্গবন্ধু প্রজন্ম লীগ', 'আওয়ামী প্রচার ও প্রকাশনা লীগ' ইত্যাদি।

\হআওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবার সদস্যদের নাম ভাঙ্গিয়ে এবং আওয়ামী লীগের সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন দাবি করে রাজনৈতিক দোকান খোলার এবং এসব রাজনৈতিক দোকানের অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা, মন্ত্রীদের উপস্থিতি বিভিন্ন মহলে সমালোচিত হয়েছে। এ সব রাজনৈতিক দোকানের ব্যাপারে সময়ে-সময়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ প্রভাবশালী নেতারা কেউ কেউ কঠোর মনোভাব ব্যক্ত করলেও এ সব রাজনৈতিক দোকানের আত্মপ্রকাশ এবং চলমান দোকানগুলো বন্ধের কার্যকর উদ্যোগ আওয়ামী লীগ হাই কমান্ডকে নিতে দেখা যায়নি। অভিযোগ আছে, আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা, মন্ত্রীসহ আওয়ামী ঘরণার বুদ্ধিজীবীরা এ সব রাজনৈতিক দোকানের কর্মসূচিতে উপস্থিত থেকে, এ সব রাজনৈতিক দোকানের কথিত নেতাকর্মীদের সঙ্গে ফটো সেসনে অংশ নিয়ে রাজনৈতিক দোকানগুলোকে প্রকারান্তরে স্বীকৃতি দিয়েছেন। এ সব রাজনৈতিক দোকানের কথিত নেতাকর্মীদের অনেকের বিরুদ্ধেই দখলবাজি, চাঁদাবাজিসহ গুরুতর অপরাধের অনিঃশেষ অভিযোগ রয়েছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকার পরও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখেও না দেখার ভান করার অভিযোগও কম নেই। প্রাচীন ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি এসব রাজনৈতিক দোকানের অপকর্মে ক্ষুণ্ন হলেও রাজনৈতিক দোকানগুলোর ঝাঁপ এবং নতুন নতুন রাজনৈতিক দোকান খোলা বন্ধ হয়নি, আদৌ বন্ধ হবে কিনা তাও নিশ্চিত করে বলা মুশকিল।

\হপ্রশ্ন হচ্ছে, ধান্ধাবাজির রাজনৈতিক দোকানগুলো আওয়ামী রাজনীতির জন্য কি জরুরি? আওয়ামী লীগ প্রাচীন রাজনৈতিক দল। দলটি দীর্ঘ পথ-পরিক্রমা অতিক্রম করে আজকের পর্যায়ে এসেছে দলের ত্যাগী নেতাকর্মীদের অবদানে। আওয়ামী লীগে এমন বহু নেতাকর্মী আছেন যারা বিভিন্ন সময় দল ক্ষমতায় থাকাকালে সামান্যতম সুযোগ-সুবিধাও নেননি, সুযোগ-সুবিধা না পাওয়ায় আক্ষেপও করেন না। অস্বীকার করা যাবে না যে, ত্যাগী নেতাকর্মীদের শক্তিতে ঝড়ঝাঁপটা মোকাবিলা করে টিকে থাকা রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ আদতেই ধান্ধাবাজদের আখড়া-আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছে। আওয়ামী লীগে 'কাউয়া', 'ফার্মের মুরগি' ঢুকেছে, 'হাইব্রিড' নেতাকর্মীতে ভরে গেছে এমন কথা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাদের মুখেও প্রায়ই শোনা যায়। আওয়ামী লীগে ধান্ধাবাজ, সুযোগ-সুবিধা সন্ধানীদের ব্যাপক সম্মিলন দৃশ্যমানই। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর চামড়া দিয়ে ঢোল, হাড্ডি দিয়ে ডুগডুগি বানাতে চেয়েছিলেন যারা তারাসহ স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নির্বিচারে হত্যাকারী গণবাহিনীর অনেকেই এখন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাই শুধু নন, আওয়ামী লীগের 'কৃপায়' গাড়িতে পতাকা লাগিয়ে দাবড়িয়ে বেড়ানোর সুযোগও পেয়েছেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন সরকার উৎখাত ও বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার জন্য সংঘটিত সেনা অভু্যত্থানের ট্যাংকগুলোতে গোলা সরবরাহের অভিযোগে অভিযুক্ত সেনাকর্মকর্তার কন্যাও আওয়ামী লীগের টিকেটে সংসদ সদস্য হয়েছেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা, হানাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও পাকিস্তান সরকারকে সহযোগিতাকারী হিসেবে অভিযুক্ত অনেকেই আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে মন্ত্রী-এমপি হওয়ার নজিরও রয়েছে।

\হ১৯৪৯ সালে আত্মপ্রকাশ করেছিল আজকের আওয়ামী লীগ। মুসলিম লীগের কোটারি স্বার্থ সন্ধানী নেতাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে মুসলিম লীগকে গণমানুষের দলে পরিণতের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যে মুসলিম লীগের এক ঝাঁক তরুণ নেতা মুসলিম লীগের সিনিয়র নেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীকে প্রধান করে এ দলের আত্মপ্রকাশ ঘটিয়েছিলেন। আত্মপ্রকাশকালে আজকের আওয়ামী লীগের নাম রাখা হয়েছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ। উর্দু আওয়াম শব্দের অর্থ জনতা বা জনগণ। আওয়ামী মুসলিম লীগের অর্থ জনতার মুসলিম লীগ। আওয়ামী মুসলিম লীগের আত্মপ্রকাশকালে আওয়ামী মুসলিম লীগের নবনির্বাচিত সভাপতি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী জাতির উদ্দেশে বলেছেন, 'আমরা নতুন কোনো দল গঠন করছি না। নবাব খাজা-গজাদের কবল থেকে মুসলিম লীগকে মুক্ত করে জনগণের (আওয়ামের) মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করছি (২৩ জুন, ২০১৪ দৈনিক যুগান্তরে আবদুল গাফফার চৌধুরীর লেখা উপসম্পাদকীয়)।' বঙ্গবন্ধুর অক্লান্ত পরিশ্রম ও অসাধারণ সাংগঠনিক ক্ষমতার গুণে অল্প সময়ের মধ্যেই আওয়ামী মুসলিম লীগ জনগণের দলে পরিণত হয়েছিল। আওয়ামের (জনগণের) দল কোটারি স্বার্থ সন্ধানীদের ভাগাড়ে পরিণত হওয়া যে ট্র্যাজেডি সে কথা বলা প্রয়োজন পড়ে না।

\হবঙ্গবন্ধু যৌবনকাল থেকেই হাতাকাটা কোট পড়তেন। যে কোটটি পরবর্তী সময়ে 'মুজিব কোট' পরিচিতি পেয়েছে। এক সময় বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ সহচরদের গায়ে মুজিব কোট শোভা পেত। মুজিব কোটের মর্যাদাও এখন ভুলণ্ঠিত হচ্ছে। বিতর্কিত, সমাজে ঘৃণিত লোকজনও রং বেরংয়ের মুজিব কোট পরিধান করে স্বার্থ হাসিলে মেতে উঠা দেখা যাচ্ছে এখন। বঙ্গবন্ধুকে শৈশব-কৈশোরে বহুবার সরাসরি দেখেছি। বঙ্গবন্ধুকে কখনো কালো রংয়ের মুজিব কোট ছাড়া রং-বেরংয়ের মুজিব কোট পরিধান করতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। বিতর্কিত, সমাজে ঘৃণিত লোকজন রং-বেরংয়ের মুজিব কোট গায়ে চড়িয়ে দাবড়িয়ে বেড়ানো মুজিব কোটের অবমাননা ছাড়া কি হতে পারে? আওয়ামী লীগ সুযোগ সন্ধানীদের ভাগাড়ে পরিণত হওয়ার এবং বিতর্কিত,সমাজে ঘৃণিত লোকজন মুজিব কোট পরিধান করে দাবড়িয়ে বেড়ানোর দায় আওয়ামী লীগ এড়াতে পারে না। আওয়ামী লীগ কেন সুযোগ সন্ধানী, ধান্ধাবাজদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয় তার কোনো সদুত্তর আওয়ামী লীগের কাছে আছে বলে মনে হয় না। ৭০ বছরের পুরনো রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের অজানা থাকার কথা নয় যে, সুযোগ-সুবিধা সন্ধানী, ধান্ধাবাজরা কখনো দলের সম্পদ হতে পারে না, এরা দলের বোঝা। দলের সুসময়-সুদিনে সুযোগ-সুবিধা সন্ধানী, ধান্ধাবাজদের দাপট দৌরাত্ম্যের কাছে দুঃসময়-দুর্দিনের ত্যাগী নেতাকর্মীরা কোণঠাসা হয়ে পড়ার ফলও ভালো হয় না।

আওয়ামী লীগ পুরনো রাজনৈতিক দল। এ দলের কলেবর বৃদ্ধির জন্য ভুঁইফোঁড় সংগঠন, রাজনৈতিক দোকান, সুযোগ-সুবিধা সন্ধানী লোকজন প্রয়োজন হতে পারে না। বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার সদস্যদের নাম ভাঙ্গিয়ে, ছবি ব্যবহার করে রাজনৈতিক দোকান খোলা এবং যে দোকানগুলো ইতোমধ্যে খোলা হয়েছে সেগুলো বন্ধের উদ্যোগ দ্রম্নত নেয়া দরকার আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধুর পরিবারের ভাবমূর্তির স্বার্থেই।

জহির চৌধুরী: কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<67456 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1