বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

কৃষিজাত পণ্য রপ্তানির বাজার বড় হচ্ছে

বাপার তথ্য অনুসারে, কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্যের অভ্যন্তরীণ বার্ষিক বাজার ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি। কাজ করছেন প্রায় ২০ লাখ মানুষ। ২০০০ সালের দিকে শুরু হয় এই খাতের পণ্য রপ্তানি। সরকারের ১০ বছরের কর অবকাশ সুবিধা, ২০ শতাংশ নগদ প্রণোদনার ফলে প্রতিযোগী দেশ ভারত, এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোর পাশাপাশি দ্রম্নত বাড়ছে দেশের রপ্তানির বাজারও। বিশ্বে খাদ্যজাত পণ্যের বড় বাজার রয়েছে- যার পরিমাণ সাত ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি। সেখানে বাংলাদেশের অংশ মাত্র ১০০ কোটি ডলার
ম ইমরান সিদ্দিকী
  ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০০:০০
কৃষিজাত পণ্য রপ্তানির বাজার বড় হচ্ছে

দিনের পর দিন কৃষিপণ্যের রপ্তানির পরিমাণ বাড়ছে। সরকার বর্তমানে কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য রপ্তানিতে ২০ শতাংশ নগদ সহায়তা দিচ্ছে। প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে শাকসবজি, আলু ও ফলমূল রপ্তানির সম্ভাবনাও বাড়ছে অনেক। সেজন্য রপ্তানির বাধাগুলো দূর করতে সরকার নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। শাকসবজি, আলু, ফলমূল ও প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য রপ্তানি বৃদ্ধির লক্ষ্যে রোডম্যাপ প্রস্তুত করা হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের গঠিত কমিটি শাকসবজি, ফলমূল রপ্তানির জন্য দুটি রোডম্যাপ প্রণয়ন করেছে। যা বাস্তবায়ন করে সরকার ২০২২-২৩ অর্থবছরে কৃষিপণ্য রপ্তানি আয় ২ বিলিয়ন ডলারে নিতে চায়।

রপ্তানি উন্নয়ন বু্যরোর (ইপিবি) তথ্য বলছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে কৃষিপণ্য রপ্তানি হতো মাত্র ৫৫ কোটি ডলারের। দেশ থেকে দিন দিন কৃষিপণ্যের রপ্তানির পরিমাণ বাড়ছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে কৃষিপণ্য রপ্তানি থেকে ১০৩ কোটি ডলার আয় এসেছে। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৯ শতাংশের বেশি। চলতি অর্থবছরের (২০২১-২২) প্রথম দুই মাস জুলাই-আগস্টে কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে প্রায় ২১ কোটি ডলার বা এক হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। এ সময় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৬ শতাংশের বেশি। গত অর্থবছরের একই সময় আয় হয় ১৭ কোটি ৮২ লাখ ডলার। মাত্র চার বছরে বাংলাদেশ থেকে কৃষিপণ্য রপ্তানি প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। আগামী দুই থেকে তিন বছরে সেটা ছয় গুণ হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন এই খাতের ব্যবসায়ী ও কৃষি অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, এই বিশাল সম্ভাবনার পথের কাঁটা অশুল্ক বাধা। সেটা দূর করা গেলে রপ্তানি আয়ে শীর্ষে থাকা তৈরি পোশাক খাতের পরেই জায়গা করে নিতে পারে কৃষিজাত পণ্য। ইউরোপ, আমেরিকা ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশসহ ১৪৪টি দেশে বাংলাদেশি কৃষিজাত পণ্য রপ্তানি হচ্ছে।

বাংলাদেশ থেকে নানাবিধ কৃষিপণ্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। এর মধ্যে পাট ও পাটজাত দ্রব্য, চা পাতা, আম, কাঁঠাল, লেবু, লিচু, লটকন, আমড়া, পেয়ারা, শুকনা বরই, হিমায়িত সবজি আলু, কচু, পটোল, মুখীকচু, লাউ, পেঁপে, শিম, করলা, কাকরুল, চিচিঙ্গা, মিষ্টি কুমড়া, গুঁড়া মসলা, কালিজিরা, হলুদের গুঁড়া, মরিচের গুঁড়া, শুকনা মরিচ, বিরিয়ানির মসলা, কারি মসলা, ড্রিংকস, বিস্কুট, চানাচুর, সেমাই, পটেটো ফ্লেকস, নুডলস, ড্রাই কেক, মুড়ি, চিড়া, ফুড স্টাফ প্রভৃতি বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে যেসব দেশে শাকসবজি রপ্তানি হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো- সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, কাতার, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব, কুয়েত, সিঙ্গাপুর, শ্রীলংকা ও নেপাল এবং যেসব দেশে ফল রপ্তানি হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো- কাতার, ভারত, ভিয়েতনাম, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কুয়েত, সৌদি আরব ও অস্ট্রেলিয়া।

সরকার কৃষিপণ্য রপ্তানির জন্য ২০ শতাংশ প্রণোদনা প্রদান করছে। কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে ইতোমধ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্যোগে পূর্বাচলে একটি অ্যাক্রিডিয়েটেড ল্যাবরেটরি নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। আশা করা যায়, সরকারের বিভিন্নমুখী উদ্যোগ, কৃষকের প্রচেষ্টা, কৃষিপণ্য রপ্তানিকারকরা কার্যক্রম ও প্রক্রিয়াজাতকারী কোম্পানিসমূহের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে কৃষিপণ্য রপ্তানির একটি নতুন দুয়ার খুলে যাবে। বাংলাদেশ অচিরেই কৃষিপণ্য রপ্তানি করে উলেস্নখযোগ্য পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেও সক্ষম হবে।

বাংলাদেশ থেকে কৃষিপণ্যের রপ্তানি আয় ১০ বছর আগেও ছিল মাত্র ৪০ কোটি ডলার। গত ৫ বছর ধরে খাতটির রপ্তানি আয় দ্রম্নত বাড়ছে। অবশ্য করোনার কারণে ২০১৯-২০ অর্থবছরে কৃষিপণ্য খাতের রপ্তানি ৫ শতাংশ কমেছিল। তবে ২০২০-২১ অর্থবছরে খাতটি ঘুরে দাঁড়ায় এবং রপ্তানি আয় ১৯ শতাংশ বাড়ে। যদিও পুরো বছরটিই করোনা মহামারির মধ্যেই কেটেছে। এ বছর করোনা প্রকোপ কমায় কৃষিপণ্য রপ্তানির গতি আরো বেড়েছে। ইপিবির তথ্য অনুসারে, ৪৭৯টি প্রতিষ্ঠান ১৪৪ দেশে প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য রপ্তানি করছে। প্রাণ-আরএফএল গ্রম্নপ ছাড়াও স্কয়ার, বিডি ফুডের মতো আরো অনেক প্রতিষ্ঠানের রপ্তানি বাজারও বেশ বড়।

কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের মধ্যে বেশি রপ্তানি হয় রুটি, বিস্কুট ও চানাচুর জাতীয় শুকনা খাবার, ভোজ্যতেল ও সমজাতীয় পণ্য, ফলের রস, বিভিন্ন ধরনের মসলা, পানীয় এবং জ্যাম-জেলির মতো বিভিন্ন সুগার কনফেকশনারি। তার বাইরে চা, শাকসবজি এবং ফলমূলও রপ্তানি হচ্ছে। অপ্রচলিত পণ্য হিসেবে পান-শুপারিসহ অন্যান্য পণ্যও বিদেশে যাচ্ছে। বর্তমানে সবজি, তামাক, ফুল, ফলসহ অন্যান্য পণ্যের রপ্তানি বেড়েছে। ১০ মাসে ৮ কোটি ৮২ লাখ ডলারের সবজি রপ্তানি হয়েছে। তাছাড়া ৯ কোটি ৩৭ লাখ ডলারের তামাক, ৩ কোটি ২৭ লাখ ডলারের মসলা রপ্তানি হয়েছে।

প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাগ্রো প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশন (বাপা) জানায়, কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য উৎপাদনের সঙ্গে ৫ শতাধিক প্রতিষ্ঠান জড়িত রয়েছে। তার মধ্যে বড় ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান আছে ২০টি। আর রপ্তানি করছে ১০০টিরও বেশি প্রতিষ্ঠান। করোনাপরবর্তী সময়ে চাহিদা বেড়েছে। পুরনো ক্রেতারা বেশি বেশি অর্ডার করছে। তবে জাহাজ ভাড়া ও কন্টেইনার সমস্যার কারণে রপ্তানি কম ছিল। সেটা না হলে সবজি রপ্তানি আরো অনেক বেশি হতো।

সঠিকভাবে সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাত না করার কারণে কৃষকের উৎপাদিত বিভিন্ন ফসলের ৩০ শতাংশই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। যদি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার মাধ্যমে প্রক্রিয়াজাত করা যায় এবং বিদেশে পাঠানো যায় তবে দেশে কর্মসংস্থান হবে, বৈদেশিক মুদ্রা আসবে। এগিয়ে যাবে দেশের অর্থনীতি। তারা বলেন, কয়েকটি দেশের সঙ্গে পণ্য রপ্তানিতে কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকার ও ব্যবসায়ীরা সম্মিলিত উদ্যোগ নিলে রপ্তানির পথ আরো প্রশস্ত হবে। বন্দরে পণ্য পাঠানো সহজ করা, দেশে বিশ্বমানের ল্যাবরেটরি স্থাপন ও রপ্তানিতে শুল্ক-অশুল্ক বাধাকে গুরুত্ব দিতে হবে। তৈরি পোশাক শিল্পের পর সবচেয়ে সম্ভাবনাময় রপ্তানির খাত হিসেবে কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য খাতটি উঠে আসছে বলে মনে করছেন তারা।

কৃষিজাত পণ্য রপ্তানিকরকরা বলছে, দেশের কৃষিজাত পণ্য রপ্তানি কিছুটা বাড়লেও পরিবহণ ব্যবস্থার ঘাটতির ফলে এর বিপুল সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। পচনশীল পণ্য হিসেবে এ খাতে বিশেষায়িত পরিবহণ ব্যবস্থা, বিশ্বমানের কৃষিপণ্য উৎপাদনে ফাইটোস্যানিটারি (উদ্ভিদ স্বাস্থ্য সম্পর্কিত) সনদ, গুড অ্যাগ্রিকালচার প্র্যাকটিস (গ্যাপ) নিশ্চিত করে পণ্য তৈরি করতে হবে। পণ্যের গুণগত মান ঠিক রাখতে রপ্তানিকারক থেকে কৃষক পর্যন্ত নিবিড় যোগাযোগ বাড়ানো এবং মূল্য সংযোজন নিশ্চিত ও সহজ করতে হবে। দেশে বিশ্বমানের কৃষিজাত পণ্যের শিল্প গড়ে তুলতে আন্তর্জাতিক মান সনদের দেশীয় সংস্থা বাংলাদেশ অ্যাক্রেডিটেশন বোর্ডকে শক্তিশালী করতে হবে।

বাপার তথ্য অনুসারে, কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্যের অভ্যন্তরীণ বার্ষিক বাজার ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি। কাজ করছেন প্রায় ২০ লাখ মানুষ। ২০০০ সালের দিকে শুরু হয় এই খাতের পণ্য রপ্তানি। সরকারের ১০ বছরের কর অবকাশ সুবিধা, ২০ শতাংশ নগদ প্রণোদনার ফলে প্রতিযোগী দেশ ভারত, এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোর পাশাপাশি দ্রম্নত বাড়ছে দেশের রপ্তানির বাজারও। বিশ্বে খাদ্যজাত পণ্যের বড় বাজার রয়েছে- যার পরিমাণ সাত ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি। সেখানে বাংলাদেশের অংশ মাত্র ১০০ কোটি ডলার।

রপ্তানিকারক আরিফুজ্জামান জানান, সার্বিকভাবে কৃষিপণ্য রপ্তানি অনেক বহুমুখী হয়েছে। আগে যেখানে ডিংকস এবং জুসের মতো মাত্র কয়েক ধরনের পণ্য রপ্তানি হতো, সেখানে এখন প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য হিসেবে ব্রেড-বিস্কুটসহ অন্যান্য কনফেকশনারির বড় বাজার ধরেছে বাংলাদেশ।

উলেস্নখ্য, দেশের কৃষকরা আবাদযোগ্য জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করেছেন। সরকারের কৃষিবান্ধব নীতি, কৃষি খাতে বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনায় কৃষি বর্তমানে একটি ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। এ কারণেই কৃষকরা প্রচলিত চাষাবাদ পদ্ধতির পাশাপাশি বিপুল পরিমাণে শাকসবজি এবং ফলমূলের আবাদ করছেন। ফলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে এখন শাকসবজি ও ফলমূল বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাতকারী কোম্পানি কৃষিজাত পণ্য প্রক্রিয়াজাত করে বিদেশে রপ্তানি করছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে