শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

১০ হাজার সংকটাপন্ন করোনা রোগী বাসায় চিকিৎসাধীন

সাখাওয়াত হোসেন
  ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০০:০০

ঢাকাসহ সারাদেশে বর্তমানে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত চিকিৎসাধীন রোগীর সংখ্যা ৯২ হাজার ১৪৪ জন। এদের মধ্যে তীব্র উপসর্গ থাকা ১০ শতাংশ এবং ৫ শতাংশ জটিল রোগীর হাই ফ্লো অক্সিজেন (?২০ লিটারের সিলিন্ডার)? ভেন্টিলেটর লাগে। তার জন্যই দরকার হাসপাতাল। সে হিসাবে সরকারি-বেসরকারি কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে প্রায় ১৪ হাজার রোগী ভর্তি থাকার কথা।

তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গত কয়েক সপ্তাহের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে গড়ে মাত্র সাড়ে তিন থেকে চার হাজার করোনা রোগী চিকিৎসাধীন। অর্থাৎ ১০ হাজারের বেশি সংকটাপন্ন রোগী ঝুঁকি নিয়ে বাসাবাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। অথচ কোভিড হাসপাতালগুলোতে সাধারণ ও আইসিইউ মিলিয়ে ১১ হাজার শয্যা ফাঁকা পড়ে আছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, আক্রান্ত ব্যক্তিদের ৪০ শতাংশের উপসর্গ থাকে মৃদু। মাঝারি মাত্রার উপসর্গ থাকে ৪০ শতাংশের। তীব্র উপসর্গ থাকে ১৫ শতাংশের। আর জটিল পরিস্থিতি দেখা যায় বাকি ৫ শতাংশের ক্ষেত্রে। তীব্র উপসর্গ ও জটিল রোগীদের প্রায় সবার এবং মাঝারি উপসর্গ রয়েছে এমন অনেক রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়।

তবে দেশে করোনা চিকিৎসার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান, তাদের অভিজ্ঞতায় বাংলাদেশে তীব্র উপসর্গ থাকা নূ্যনতম ১০ শতাংশ এবং ৫ শতাংশ জটিল রোগীর হাসপাতালে ভর্তি হওয়া লাগে। বাকিরা আইসোলেশনে থেকে টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন। অথচ যে ১৫ শতাংশ সংকটাপন্ন রোগীর হাসপাতালে ভর্তি হওয়া জরুরি তাদের দুই-তৃতীয়াংশই মৃতু্যঝুঁকি নিয়ে বাসাবাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। যা দেশে করোনায় মৃতু্যর হার বাড়িয়েছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, চিকিৎসা না পাওয়া এবং ভোগান্তির কারণে করোনা বিস্তারের শুরু থেকেই মানুষ সরকারি হাসপাতালবিমুখ। অন্যদিকে নানামুখী প্রতারণা ও গলাকাটা বিলের কারণে সাধারণ মানুষ চরম বিপদে না পড়লে বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে না। জনগণের আস্থা সংকটের এ বিষয়টি শুরু থেকেই সরকারের নীতিনির্ধারক মহল অবগত আছে। এ কারণে জুলাইয়ের শেষভাগে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ৪৫ কর্মকর্তার সমন্বয়ে একটি মনিটরিং কমিটিও গঠন করা হয়। যদিও এ কমিটি শুরু থেকেই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে আসছে। যা হাসপাতালের বিপুলসংখ্যক শয্যা ফাঁকা থাকার চিত্রেই প্রমাণিত হয়েছে বলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা দাবি করেছেন।

তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলেন, চিকিৎসা নিয়ে মানুষের আস্থার সংকট আছে বলে তারা মনে করেন না। তাদের ভাষ্য, কিছু সমস্যা বা অভিযোগ ছিল, সেগুলো সমাধানের জন্য মনিটরিং জোরদার করাসহ আনুষঙ্গিক বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এতে পরিস্থিতির যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। সংক্রমণের গতি ও জনমনে আতঙ্ক কমায় হাসপাতালে রোগী ভর্তির সংখ্যা কমেছে।

তবে তাদের এ দাবির সঙ্গে বাস্তবতার কতটুকু মিল আছে তা সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন কোভিড ডেডিকেটের হাসপাতাল ঘুরে এবং সেখানে চিকিৎসাধীন রোগীর স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া গেছে।

রাজধানীর ধানমন্ডির আনোয়ার খান মর্ডান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এক রোগীর স্ত্রী জানান, গত ১০ দিনে তারা প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা বিল পরিশোধ করেছেন। এরপরও তাদের কাছে আরও সোয়া লাখ টাকা বিল বকেয়া রয়েছে বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের জানিয়েছে। এ বিশাল অঙ্কের অর্থ জোগাড় করতে তাকে আত্মীয়-স্বজনের কাছে হাত পাততে হয়েছে। বেসরকারি হাসপাতালে করোনার চিকিৎসা করানো তাদের মধ্যে মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য 'স্বপ্নবিলাস' ছাড়া আর কিছুই না বলে মন্তব্য করেন তিনি।

বেসরকারি হাসপাতালে গলাকাটা পরিশোধ করতে হয় তা জেনেও স্বামীকে কেন সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করেননি তা জানতে চাইলে বয়োবৃদ্ধ ওই নারী জানান, তারা সেখানে ভর্তি করানোর আগে বেশ কয়েকটি সরকারি হাসপাতালে খোঁজ নিয়েছেন; কিন্তু সেখানে চিকিৎসাধীন রোগী ও তাদের স্বজনদের কাছ থেকে যে তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা শুনেছেন, তাতে তারা সেখানে ভর্তি করানোর সাহস পাননি।

সরকারি হাসপাতালের বিপুলসংখ্যক সাধারণ শয্যা ও আইসিইউ খালি থাকার পরও সেখানে ভর্তি না করার কারণ হিসেবে আক্রান্ত ব্যক্তিদের স্বজনরা বেশির ভাগই সেখানে কাঙ্ক্ষিত সেবা পাওয়া নিয়ে তাদের সংশয়ের কথা জানিয়েছেন। আল-আরাফা ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তা আবু ইউসুফ জানান, তার বড় ভাই করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর বাড়িতে চিকিৎসা, এমনকি অক্সিজেন দিয়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন হাসপাতালে ভর্তি না করার। তবে শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়ায় পরে বাধ্য হয়ে তাকে ইমপালস হাসপাতালে ভর্তি করান। বেসরকারি হাসপাতালে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, পত্র-পত্রিকা, টিভি ও ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা ব্যবস্থার যে দুর্দশার চিত্র প্রকাশ পেয়েছে তা জেনে পরিবারের কেউ সেখানে ভর্তি করানোর ব্যাপারে সায় দেননি।

এদিকে গত ২৭ জুলাই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ৪৫ কর্মকর্তার সমন্বয়ে গঠিত মনিটরিং কমিটির প্রত্যেক সদস্যকে প্রতি মাসে অন্তত একটি হাসপাতাল পরিদর্শন করে সেখানকার সমস্যা চিহ্নিত করতে বলা হলেও কার্যত তারা সে দায়িত্ব কতটা পালন করেছেন তা বাস্তব চিত্র পর্যবেক্ষণে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন, অথচ সেখানকার ভোগান্তি কিংবা গলাকাটা বিলের অভিযোগ করেননি, এমন মানুষের সংখ্যা নেই বললেই চলে। বরং একেক জন একেক ধরনের দুর্ভোগ-হয়রানি ও বিড়ম্বনার কথা জানিয়েছেন।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য, ৪৫ কর্মকর্তার প্রত্যেকে প্রতি মাসে একটি করে হাসপাতাল পরিদর্শন করলেও গত দুই মাসে অন্তত ৯০টি হাসপাতালের সমস্যা চিহ্নিত হওয়ার কথা। তারা যথাযথভাবে সে দায়িত্ব পালন করলে কোভিড হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা সংকট অনেক আগেই কাটতো বলে মনে করেন তারা।

দেশের করোনা পরিস্থিতি ও চিকিৎসা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণকারী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, করোনাভাইরাসের পরীক্ষা থেকে শুরু করে চিকিৎসা প্রতিটি ক্ষেত্রেই চরম অব্যবস্থাপনার নানা অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া জেকেজি এবং রিজেন্ট হাসপাতালের প্রতারণা ধরা পড়ার পর মানুষের মধ্যে চিকিৎসা নিয়ে অনাস্থা আরও বেড়ে গেছে। আর এ অনাস্থা থেকে মানুষ হাসপাতালবিমুখ হয়েছে। মনিটরিং কমিটি গঠন করার পর স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি নিয়ে অনেকে আশায় বুক বাঁধলেও পরে তাদের হতাশ হতে হয়েছে।

এদিকে বেশ দেরিতে হলেও হাসপাতাল মনিটরিংয়ে অবশেষে নজর দেওয়ার বিষয়টি ইতিবাচক হিসেবে দেখেছিলেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা আশা করেছিলেন, অব্যবস্থাপনা ও জালিয়াতির কারণে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের ওপর সাধারণ মানুষের যে আস্থাহীনতা দেখা দিয়েছে, মনিটরিং কমিটির তৎপরতায় সে সংকট ধীরে ধীরে কেটে যাবে। তবে দীর্ঘ দু'মাস পরও সে অবস্থার কোনো পরিবর্তন না হওয়ায় তাদের সে আশা ভঙ্গ হয়েছে।

এ নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, করোনা মোকাবিলা এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার অনিয়ম-দুর্বলতা দূর করতে একের পর এক কমিটি গঠন করা হয়। অথচ বাস্তবে এসব কমিটির কোনো তৎপরতা নেই, যা প্রকারান্তরে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা। এ অবস্থা চলতে থাকলে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় নানা অব্যবস্থাপনা জেঁকে বসবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তারা।

স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, শুধু সমন্বিত মনিটরিং কমিটিই নয়, করোনা মোকাবিলায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর একে একে আরও ৪৩টি কমিটি গঠন করেছে, যার সিংহভাগই নিষ্ক্রিয়। অনেক কমিটির নিয়মিত সভাও হচ্ছে না। বেশ কয়েকটি কমিটি ইতোমধ্যে ভেঙে দেওয়া হলেও তা খোদ সদস্যদেরই কারও কারও অজানা।

করোনা পরিস্থিতি জানা-বোঝা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার জন্য যে তথ্য-উপাত্ত দরকার, তা জনস্বাস্থ্যবিদ ও গবেষকরা পাচ্ছেন না। নমুনা সংগ্রহ ও রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষা হতাশাজনক। আস্থা না থাকায় মানুষ ঝুঁকি নিয়ে বাসাবাড়িতে চিকিৎসা নিলেও হাসপাতালে যেতে চাচ্ছেন না। রাজধানীসহ দেশের বহু এলাকায় আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা ব্যক্তি খোঁজা বা কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং কার্যত বন্ধ। অথচ এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কমিটিগুলো কোনো নজর দিচ্ছে না।

জনস্বাস্থ্যবিদ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বেনজির আহমেদ বলেন, কমিটি গঠনের মূল উদ্দেশ্য হওয়ার কথা ছিল করোনা মোকাবিলায় জাতীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন; কিন্তু শুরু থেকে যেভাবে ও যে ধরনের কমিটি হয়েছে তাতে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন পুরোপুরি সম্ভব হয়নি। আগামীতেও আশানুরূপ কিছু হবে সে সম্ভাবনাও ক্ষীণ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সমন্বিত নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ১২ সেপ্টেম্বর ঢাকার ২১ হাসপাতালের ৬ হাজার ১০৭টি সাধারণ শয্যার মধ্যে ১ হাজার ৯৯৪টি শয্যায় এবং আইসিইউর ৩০৭টি শয্যার মধ্যে ১৭৯টি শয্যায় রোগী ভর্তি ছিল। অর্থাৎ মোট শয্যা অনুপাতে রোগী ভর্তির হার ৩৩ দশমিক ৮৭ শতাংশ। এছাড়া চট্টগ্রামে ৯টি হাসপাতালের ৩৯টি আইসিইউসহ ৮২১ শয্যার মধ্যে ১৮৪টিতে রোগী ভর্তি ছিল, অর্থাৎ ভর্তির হার ২২ দশমিক ৪১ শতাংশ।

অন্যদিকে ঢাকা ও চট্টগ্রাম ছাড়া সারাদেশে মোট ৭ হাজার ৩৮৬টি সাধারণ শয্যার মধ্যে ১ হাজার ১৫৩টিতে এবং ২০১টি আইসিইউর মধ্যে ৯৫টিতে রোগী ভর্তি ছিল। এ হিসাবে মোট ভর্তির হার ছিল ১৬ দশমিক ৪৪ শতাংশ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<112233 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1