শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

'হিরোইজম' দেখাতে শিক্ষককে হত্যা

মামলায় জিতুর বয়স ১৬ জেডিসি সনদে ১৯ র্:যাব পাঁচ দিনের রিমান্ডে জিতু গাজীপুরে বন্ধুর আশ্রয়ে ছিল
যাযাদি ডেস্ক
  ০১ জুলাই ২০২২, ০০:০০

স্কুল ক্যাম্পাসে বান্ধবীকে নিয়ে ঘোরাফেরা করতে 'নিষেধ করেছিলেন' শিক্ষক উৎপল কুমার সরকার; সেই ক্ষোভে আর 'হিরোইজম' দেখাতে স্কুলছাত্র আশরাফুল ইসলাম জিতু শিক্ষককে স্টাম্প দিয়ে বেধড়ক পেটান। গত ২৫ জুন দুপুরে আশুলিয়ার হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের মাঠে ওই ঘটনার পরদিন মারা যান শিক্ষক উৎপল।

পরে বুধবার জিতুকে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার নগরহাওলা গ্রামে এক বন্ধুর বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করের্ যাব। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের পর বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর কাওরান বাজারের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরেনর্ যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন।

এদিকে, শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় আশরাফুল ইসলাম জিতুর ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। বৃহস্পতিবার মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও আশুলিয়া থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) এমদাদুল হক জিতুকে আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রাজীব হাসান তার ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে আদেশ দেন।

খন্দকার আল মঈন বলেন, 'জিতুর বিরুদ্ধে স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে উচ্ছৃঙ্খলতার অভিযোগ রয়েছে। ইভটিজিং, স্কুলের ভেতরে ধূমপান, স্কুল কম্পাউন্ডে বেপরোয়া বাইক চালানোর মতো অনেক অভিযোগ রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, 'স্থানীয় প্রভাবশালী পরিবারের এই ছেলে "জিতু দাদা" নামে একটি কিশোর গ্যাং তৈরি করেছিল। বিভিন্ন সময় মাইক্রোবাস ভাড়া করে ঘুরত, মানুষকে হেনস্থা করত। তার বিরুদ্ধে বিচার দেওয়া হলে আরও ভয়-ভীতি দেখাত, মোটর সাইকেল নিয়ে শোডাউন করত। জিতুর এসব কর্মকান্ডের কারণে বিভিন্ন সময় শিক্ষার্থীরা স্কুল কর্তৃপক্ষকে অভিযোগ করেছে। স্কুলের শৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি হিসেবে উৎপল কুমার সরকার চেষ্টা করেছেন জিতুকে 'কাউন্সিলিং' করতে, এ ধরনের কাজ থেকে বিরত রাখতে।'

র্

যাব কর্মকর্তা বলেন, জিতুর পরিবার 'মোটামুটি' অবস্থাসম্পন্ন। ওই স্কুলের মালিকপক্ষ সবাই বিভিন্নভাবে জিতুর আত্মীয়। তাদের নিজেদের মাইক্রোবাস, মোটর সাইকেল রয়েছে। এলাকায় তাদের প্রভাব রয়েছে। এভাবে সে তার বন্ধু-বান্ধবসহ একটি গ্রম্নপ মেইনটেইন করত। এসব কারণে বিভিন্ন সময় তার শিক্ষাজীবনে ব্যাঘাত ঘটেছে। এলাকায় যেহেতু কিছুটা আধিপত্য ছিল, এ কারণে অনেক ক্ষেত্রেই সে পার পেয়ে যেত।'

তিনি আরও বলেন, 'কিছুদিন আগে জিতু কলেজপড়ুয়া এক ছাত্রীর সঙ্গে স্কুল কম্পাউন্ডের ভেতরে ঘোরাফেরা করছিল। উৎপল শৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি হিসেবে জিতু ও ওই ছাত্রীকে বোঝাতে চেষ্টা করেছেন। জিতু স্কুল প্রাঙ্গণে ধূমপান করত, তাকে চুল কাটার জন্য বলা হতো, বেপরোয়া মোটর সাইকেল নিয়ে প্রবেশে নিষেধ করা হতো। এসব নিয়ে জিতুকে অনেকবার বলেছেন শিক্ষক উৎপল। এ বিষয়েও ক্ষোভ ছিল জিতুর। সর্বশেষ ওই ছাত্রীর ঘটনা যুক্ত হয়।'

র্

যাব কর্মকর্তা বলেন, 'সেই ছাত্রীর সামনে হিরোইজম দেখানোর জন্য শিক্ষককে স্টাম্প নিয়ে আঘাত করে জিতু। এজন্য ২৫ জুন পরিকল্পনা করে বাসা থেকে স্টাম্প নিয়ে স্কুলে যায়। শিক্ষক উৎপলকে আঘাত করার জন্য বিভিন্ন জায়গায় খুঁজতে থাকে। শিক্ষক উৎপল সে সময় মাঠে ক্রিকেট খেলা পরিচালনা করছিলেন। মাঠের এক কোণে তাকে একা পেয়ে পেছন থেকে আঘাত করে জিতু। এরপর আরও কয়েকটি এলোপাতাড়ি আঘাত করে জিতু স্কুল ছেড়ে এলাকায় গিয়ে অবস্থান নেয়। যখন সন্ধ্যায় জানাজানি হয়, শিক্ষক উৎপলের অবস্থা গুরুতর, তখন জিতু মানিকগঞ্জে এক আত্মীয়ের বাসায় চলে যায়।'

তিনি জানান, মানিকগঞ্জ থেকে যখন জিতু বুঝতে পারেন যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে অনুসরণ করছে, তখন পাবনায় এক পরিচিত ব্যক্তির বাসায় চলে যান জিতু। মঙ্গলবার ভোরে আরিচা হয়ে গাজীপুরের শ্রীপুর এলাকায় দনুয়া গ্রামে তার এক বন্ধুর বাড়িতে যায়। পরে সেই বাড়ি থেকের্ যাব-৪ ওর্ যাব-১ এর যৌথ দল তাকে গ্রেপ্তার করে।

এদিকে, শিক্ষক উৎপলকে হত্যার ঘটনায় করা মামলার এজাহারে জিতুর বয়স ১৬ থাকায় তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। আইন অনুযায়ী ১৮ বছরের কম বয়সিদের অপরাধের বিচার হয় কিশোর আইনে। সেই সুবিধা পাইয়ে দিতে জিতুর বয়স কম দেখানো হয়েছে কি-না, সেই প্রশ্নও তুলেছেন স্থানীয়রা। তবে তার বয়স ১৯ বলে জানিয়েছের্ যাব।

র্

যাব কর্মকর্তা বলেন, 'জিতুকে গ্রেপ্তারের পর তার কলেজ থেকে জুনিয়র দাখিল পরীক্ষার সার্টিফিকেট সংগ্রহ করা হয়। সেখানে তার জন্ম তারিখ রয়েছে ২০০৩ সালের ১৭ জানুয়ারি। সে অনুযায়ী তার বয়স ১৯ বছর। কিন্তু মামলার এজাহারে লেখা ১৬ বছর।'

খুনের ওই মামলায় জিতুর বাবা উজ্জ্বল হোসেনকে বুধবার ভোরে কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতের নির্দেশে পাঁচদিনের হেফাজতে নেওয়া হয়। এ মামলায় বাবা কেন গ্রেপ্তার- এমন প্রশ্নের্ যাব কর্মকর্তা মঈন বলেন, 'মামলার বিজ্ঞ আইও (তদন্ত কর্মকর্তা) তদন্তের স্বার্থে মনে করেছেন, তার বাবার রিমান্ড প্রয়োজন, এজন্য তারা রিমান্ড চেয়েছেন।'

তবে জিতুকে পালাতে সহায়তা করার ক্ষেত্রে আর কারও সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি জানিয়ে তিনি বলেন, 'জিতু এক কাপড়েই পালিয়ে যায়। এভাবেই সে বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান করছিল। সে যে পালিয়ে ছিল, একদমই ট্রেসলেস। তার সঙ্গে কেউ ছিল না। এ কারণে তাকে ধরতে একটু দেরি হয়েছে। কেউ তাকে পালাতে সহায়তা করেছে এমন তথ্য পায়নির্ যাব।'

গাজীপুরে বন্ধুর আশ্রয়ে ছিল: এদিকে, আমাদের গাজীপুর প্রতিনিধি জানান, আশরাফুল আহসান জিতুকে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার নগরহাওলা গ্রাম থেকে বুধবার বিকালে গ্রেপ্তার করেছের্ যাব। তিনি ওই এলাকায় বশির শরিফ নামের তার সহপাঠী বাল্যবন্ধুর আশ্রয়ে ছিলেন।

বশিরের বাড়ি নড়াইল জেলার কালিয়া উপজেলার বাইউসোনা গ্রামে। তিনি গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার নগরহাওলা গ্রামে মোশাররফ হোসেনের ভাড়া বাড়িতে বড় ভাই ইমরান বিশ্বাস ও বড় বোন জিনিয়া আক্তারের সঙ্গে বসবাস করেন। বুধবার ভোরে জিতু মানিকগঞ্জ থেকে বন্ধু বশিরের ভাড়া বাড়িতে আসেন বলে জানান তিনি।

বশির বলেন, 'জিতুর সঙ্গে হাজী ইউনুছ আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজে একসঙ্গে পড়াশোনা করতাম। নবম শ্রেণি থেকে জিতুর সঙ্গে আমার পরিচয়। মঙ্গলবার জিতু তার নানার বাড়ি মানিকগঞ্জে ছিলেন। সেখান থেকে মোবাইল ফোনে আমাকে ফোন করে এখানে আসার কথা জানান। বুধবার ভোরে জিতু শ্রীপুরের মাওনা চৌরাস্তায় এসে আমাকে ফোন করেন এবং তার বাড়িতে কয়েকদিন বেড়ানোর কথা জানান। আমি তাকে মাওনা চৌরাস্তা থেকে বাসযোগে জৈনাবাজার এলাকায় আসতে বলি। জৈনাবাজার থেকে তাকে রিসিভ করে বাসায় নিয়ে আসি। এই ভাড়া বাড়ি থেকেই বুধবার বিকালে তাকে গ্রেপ্তার করের্ যাব।

বশির আরও জানায়, জিতু এখানে এসেই তার বাবা এক হাজার টাকা পাঠাবে বলে আমাকে জানান। পরে আমি তার বাবার পাঠানো এক হাজার টাকা উঠাতে স্থানীয় একটি কারখানার সামনে যাই। এ সময় হঠাৎর্ যাব সদস্যরা তাদের পরিচয় দিয়ে জিতুর ছবি দেখিয়ে তার পরিচয় ও কোথায় আছে জানতে চায়। পরে আমি তাদের সুজনের ভাড়া বাড়িতে নিয়ে আসি। এ সময় জিতু ঘুমিয়ে ছিল। পরের্ যাব সদস্যরা তাকে ডেকে তুলে নিয়ে যায়।

বাড়ির মালিক সিদ্দিকুর রহমান জানান, ওই ছেলেটিকে তারা কেউই চিনেন না। বুধবার বিকালে মাগরিবের নামাজের আগে হঠাৎই বাড়ির ভেতর কিছু লোকজন এসে বিভিন্ন ঘরে তলস্নাশি শুরু করে। এ সময় ঘুম থেকে ডেকে তুলে এক ছেলেকে হ্যান্ডকাফ পরানো হয়। পরে সেখানে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।

স্কুলের ম্যানেজিং কমিটি বাতিল : এদিকে সাভারের আশুলিয়ায় শিক্ষক উৎপল কুমার সরকার হত্যাকান্ডের ঘটনায় হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের ম্যানেজিং কমিটি স্থগিত করা হয়েছে।

ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক অধ্যাপক আবু তালেব মো. মোয়াজ্জেম হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির এক ছাত্র স্টাম্প দিয়ে পিটিয়ে শিক্ষক উৎপলকে হত্যা করেছে। অভিযুক্ত ছাত্র ওই প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মো. সুমনের ভাতিজা। তার প্রভাবেই ওই ছাত্র প্রভাব দেখিয়ে ইচ্ছামতো চলাফেরা করত।

তিনি আরও জানান, 'বৃহস্পতিবার এক বৈঠকে ওই কমিটি স্থগিত করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটিতে ম্যানেজিং কমিটির অনুমোদন দেওয়া হয়নি। প্রক্রিয়াধীন ছিল। আমরা প্রক্রিয়াধীন অবস্থাতেই এই কমিটি স্থগিত করেছি।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে