শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আজ পাঁচ উপজেলা হানাদারমুক্ত দিবস

দোয়া-মাহফিল, আলোচনা সভা, স্মৃতিস্তম্ভে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধাসহ নানা কর্মসূচির মাধ্যমে দিবসটি পালিত হচ্ছে
স্বদেশ ডেস্ক
  ০৪ ডিসেম্বর ২০২০, ০০:০০

আজ ৪ ডিসেম্বর দিনাজপুরের ফুলবাড়ী, গাইবান্ধার ফুলছড়ি, চুয়াডাঙ্গার জীবননগর, চাঁদপুরের মতলব, জামালপুরের বকশীগঞ্জের কামালপুর হানাদারমুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনী যৌথভাবে পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে প্রাণপণ যুদ্ধ করে এসব এলাকা শত্রম্নমুক্ত করেন এবং স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ওড়ান। দিনটিকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে প্রতি বছর ৪ ডিসেম্বর হানাদারমুক্ত দিবস হিসেবে পালন করে আসছে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও সাধারণ মানুষ। এবারও এ উপলক্ষে নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। দোয়া-মাহফিল, আলোচনা সভা, স্মৃতিস্তম্ভে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধাসহ নানা কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর :

ফুলবাড়ী (দিনাজপুর) : ফুলবাড়ী মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা এছার উদ্দিনসহ দেশকে শত্রম্নমুক্ত করার লড়াইয়ে অংশ নেয়া বীর সেনানী একাধিক মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর ভোর থেকে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনী যৌথভাবে উপজেলার বেতদিঘী, কাজিয়াল, এলুয়াড়ী, জলপাইতলী, পানিকাটা, রুদ্রানী, আমড়া ও রানী নগর এলাকার বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে দখলদার পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে চতুর্মুখী আক্রমণ শুরু করে। মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর চতুর্মুখী আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পড়ে হানাদার বাহিনী। হানাদার বাহিনী তাদের নিশ্চিত পরাজয় বুঝতে পেরে মিত্র বাহিনীদের ফুলবাড়ী শহরে আগমন রোধ করতে পৌর শহরের পশ্চিম দিকে ছোট যমুনা নদীর উপর লোহার ব্রিজটি শক্তিশালী ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়। যা পরে ইট-সিমেন্ট দ্বারা পুনঃস্থাপন করা হয়। ব্রিজটি এখনো মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতির কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ব্রিজটি উড়িয়ে দেয়ায় ফুলবাড়ী শহরে প্রবেশ করতে মিত্রবাহিনীর দেরি হয়। এই সুযোগে হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগীরা বিশেষ ট্রেনে সৈয়দপুরে পালিয়ে যায়। এরপর সন্ধ্যা ৭টায় প্রবেশ করে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনী শহরের সড়ক ও জনপদে ডাকবাংলো চত্বরে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে ফুলবাড়ীকে শত্রম্নমুক্ত ঘোষণা করেন।

এদিকে প্রতি বছর ৪ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ফুলবাড়ী মুক্ত দিবস পালন করে এলেও, বিভিন্ন কারণে সেই দিবসের কর্মসূচিতে ভাটা পড়েছে।

সাঘাটা (গাইবান্ধা) : ৪ ডিসেম্বর গাইবান্ধা জেলার প্রথম হানাদারমুক্ত হয় ফুলছড়ি থানা। মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়ে এই দু'থানা সদরকে হানাদারমুক্ত করেন। মুক্তিযোদ্ধারা ৪টি দলে বিভক্ত হয়ে ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর গভীর রাতে ফুলছড়ি থানার চারপাশে অবস্থান নেন এবং সূর্য ওঠার আগেই ফুলছড়ি থানায় আক্রমণ করেন। এতে পাকবাহিনীর ২৭ জন সৈন্য এবং ৫ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। বেলা ওঠার সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানি সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করে। সম্মুখযুদ্ধে শহীদরা হলেন- বীর মুক্তিযোদ্ধা আফজাল হোসেন, কবেদ আলী, জাহেদুর রহমান বাদল, ওসমান গনি ও আব্দুল সোবাহান।

১১ নং সেক্টর কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা গৌতম চন্দ্র মোদক জানান, শহীদদের মৃতদেহ উদ্ধার করে পাশের সাঘাটা উপজেলার সেগুনা ইউনিয়নের খামার ধনারুহা গ্রামে এনে কবরস্থ করা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই ৫ শহীদের সম্মানার্থে ইউনিয়নটির নাম পরিবর্তন করে মুক্তিনগর রাখা হয়। বর্তমান সরকারের আমলে শহীদদের কবরস্থানগুলো সংরক্ষণ করা হয় যথাযথভাবে।

আজকের এই দিনে মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের স্বজনদের সম্মান ও মর্যাদা জানাতে সাঘাটার মুক্তিনগরে আয়োজন করা হয় নানা কর্মসূচি। সর্বস্তরের মানুষ এই স্মৃতিস্তম্ভে এসে ফুল দিয়ে শহীদ ও তাদের স্বজনদের সম্মান জানান।

জীবননগর (চুয়াডাঙ্গা) : এ দিন মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় মিত্র বাহিনীর তুমুল প্রতিরোধের মুখে পাক হানাদার বাহিনী এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর জীবননগর ছেড়ে পাশের জেলা ঝিনাইদহে পালিয়ে যায়।

জীবননগর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা সামসুল আলম সাত্তার জানান, ১৯৭১ সালের ২৬ নভেম্বর জীবননগরে পাক হানাদার বাহিনীর পতন ঘটলেও চূড়ান্ত বিজয় আসে ৪ ডিসেম্বর। এ দিন প্রতু্যষে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর কমান্ডার মেজর দত্ত ও ৮ নং সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন মোস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্র বাহিনী যৌথভাবে জীবননগরের ধোপাখালী সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করে জীবননগর, দত্তনগর, সন্তোষপুর ও হাসাদহ পাকবাহিনীর উপর অতর্কিতভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুরু হয় রক্তক্ষয়ী সম্মুখ যুদ্ধের। এ যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর ২৯ বেলুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা যৌথ বাহিনীর কাছে পরাজিত হয়ে ঝিনাইদহে পালিয়ে যায়।

সেই থেকে ৪ ডিসেম্বর জীবননগরমুক্ত দিবস হিসেবে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, সাংস্কৃতিক সংগঠন ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ পালন করে আসছে।

মতলব (চাঁদপুর) : ১৯৭১ সালের এদিনে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী মতলবের মাটি থেকে বিতাড়িত হয় এবং মতলব স্বাধীন হয়। ১৯৭১ সালের ৮ এপ্রিল ঢাকা থেকে সড়কযোগে পাকবাহিনী মতলবে আসে এবং থানা দখল করে তাদের ক্যাম্প স্থাপন করে। তারা মতলবের বিভিন্ন এলাকায় নির্বিচারে মানুষ হত্যা করে এবং ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। পাকিস্তানি সৈন্য ও তার এদেশীয় দোসররা মতলবের এনায়েতনগর গ্রামে ৫ হাজার ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয় এবং বহু নারীর সম্ভ্রম কেড়ে নেয়। তখন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার কবির আহমদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা মতলবের খিদিরপুর, বহরী, বাগানবাড়ি, মোহন ও এনায়েতনগর এলাকায় ৫টি ঘাঁটি তৈরি করে হানাদার বাহিনী মোকাবেলা করে। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা দখলদার পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে লালারহাট, বোয়ালমারি এবং নাগদাসহ আরও কটি স্থানে সম্মুখযুদ্ধে লিপ্ত হয়। মুক্তিযোদ্ধা এবং সর্বস্তরের জনগণের প্রবল প্রতিরোধের মুখে অবশেষে ৪ ডিসেম্বর পাক দখলদার বাহিনী নদীপথে মতলব ছাড়তে বাধ্য হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মতলবের ১৮ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।

৪ ডিসেম্বর সকাল ৯টায় বিজয় ভবনে জাতীয় ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পতাকা উত্তোলন, ৯টা ৩০ মিনিটে দীপ্তবাংলা পাদদেশে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হবে।

বকশীগঞ্জ (জামালপুর) : ১৯৭১ সালে আজকের দিনে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে হানাদার বাহিনীর শক্তিশালী ঘাঁটি কামালপুর দুর্গের পতন হয়। তাই দিনটিকে স্মরণ করে প্রতি বছরই স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা হানাদারমুক্ত দিবস পালন করে আসছে। কামালপুর মুক্ত দিবস উপলক্ষে এবারও পালন করবে ১১ নম্বরের মুক্তিযোদ্ধারা।

জেলার মহেন্দ্রগঞ্জ ও জামালপুর জেলার পাহাড় ঘেঁষা বকশীগঞ্জ উপজেলার ধানুয়া কামালপুরে হানাদার বাহিনী যুদ্ধের শুরু থেকেই শক্তিশালী ঘাঁটি গড়ে তুলেছিল। এখান থেকেই হানাদার বাহিনীর সদস্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের উপর হামলা চালায়। উত্তর রণাঙ্গনের ১১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল যে কোনো মূল্যে এই ঘাঁটি দখল করা। এই যুদ্ধে কামালপুর রণাঙ্গনে হানাদার বাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের ৮ দফা সম্মুখ যুদ্ধ হয়।

৩১ জুলাইয়ের আগে ধানুয়া কামালপুর রণাঙ্গনে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেন জেড ফোর্স। জেড ফোর্সের অধিনায়ক মেজর জিয়াউর রহমান পাক বাহিনীর সঙ্গে মোকাবেলা করেন। তৎকালীন ৩১ জুলাই সম্মুখযুদ্ধে পাক বাহিনীর গুলিতে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ বীর উত্তম শাহাদাৎ বরণ করেন। ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ শহীদ হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধারা সেক্টর কমান্ডার মেজর আবু তাহেরের (পরে কর্নেল) পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৪ নভেম্বর হানাদার বাহিনীর ধানুয়া কামালপুর ঘাঁটি অবরোধ করেন।

১০ দিন প্রচন্ড যুদ্ধের পর ৪ ডিসেম্বর সকাল ৮টায় সেক্টর কমান্ডারের নির্দেশক্রমে মুক্তিযোদ্ধা বশির আহমেদ (বীর প্রতীক) পাক বাহিনীর ক্যাম্পে সারেন্ডার পত্র নিয়ে যাওয়ার পর সন্ধ্যা ৭টায় ৩১ ব্যালুচ রেজিমেন্টের গ্যারিসন কমান্ডার আহসান মালিকসহ ১৬২ জন হানাদার বাহিনীর সদস্য মিত্র বাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে। শত্রম্নমুক্ত হয় ধানুয়া কামালপুর। ধানুয়া কামালপুর যুদ্ধে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ (বীর উত্তম), মুক্তিযোদ্ধা গাজী আহাদুজ্জামান, তসলিম উদ্দিনসহ শহীদ হন ১৯৭ জন মুক্তিযোদ্ধা। গুলিবিদ্ধ হয়ে ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন আহম্মেদ বীর বিক্রম (সাবেক মন্ত্রী মেজর হাফিজ)সহ অনেকেই পঙ্গুত্ব বরণ করেন।

অন্যদিকে একজন ক্যাপ্টেনসহ হানাদার বাহিনীর ২২০ জন সৈন্য মারা যায় এ যুদ্ধে। ধানুয়া কামালপুর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ২৯ জনকে তাদের বীরত্বের জন্য বীর বিক্রম, বীরউত্তম ও বীরপ্রতীক খেতাব দেওয়া হয়। শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে তৎকালীন বিডিআরের (বর্তমানে বিজিবি) নিজস্ব অর্থায়নে ধানুয়া কামালপুর স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। করা হয়েছে ধানুয়া কামালপুর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। প্রতিদিন শত শত মানুষ এই জাদুঘরে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন স্মৃতি ও প্রামাণ্যচিত্র দেখতে আসেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে