বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

ফসল উৎপাদনে ন্যানো ফাটির্লাইজার

ন্যানো ফাটির্লাইজার হচ্ছে ‘¯েøা রিলিজার’। এটি ফসলের ক্ষেতে ব্যবহার করলে গাছের গোড়ায় জমা থাকবে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী গাছকে পুষ্টি সরবরাহ করতে সক্ষম হবে। কোনো অপচয় যেমন হবে না তেমনি গাছটিও সঠিক সময়ে সঠিক পরিমাণ খাদ্য গ্রহণ করতে পারবে। আকারে ছোট হওয়ায় বীজের ক্ষুদ্র ছিদ্র দিয়ে এই পাটিের্কল বীজের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেও প্রয়োজনীয় খাদ্য সরবরাহ করতে পারবে। ফলে উৎপাদন বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে। এ নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেনÑ কৃষিবিদ এম আব্দুল মোমিন
নতুনধারা
  ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮, ০০:০০
ফসল উৎপাদনে ন্যানো ফাটির্লাইজার

বিশ্বের সবার্ধুনিক ন্যানো টেকনোলজির সাহায্যে দেশের বিজ্ঞানীরা ‘ন্যানো ফাটির্লাইজার’ তৈরির উদ্যোগ নিয়েছেন। ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং উৎপাদন ব্যয় কমানোর পাশাপাশি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে এটিকে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ কাউন্সিল ফর সাইন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসাসের্র (বিসিএসআইআর) বিজ্ঞানীরা ‘ন্যানো ফাটির্লাইজার’ তৈরির পর বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উৎপাদনে যাওয়ার জন্য নিজস্ব উদ্যোগে এর গবেষণা কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। ন্যানো টেকনোলজি বিশ্বের অত্যাধুনিক ক্ষুদ্র প্রযুক্তি যা সহজেই ফসলের মূলে প্রবেশ করে তার জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য সরবরাহ করতে পারবে। এর ব্যবহারে তৈরি সার ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি উৎপাদন ব্যয় হ্রাস এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাতেও সহায়ক হিসেবে কাজ করবে।

ফসল উৎপাদনে গুরুত্বপূণর্ এলিমেন্ট সার। আগের দিনে মানুষ বাড়িতে যে সব আবজর্না থাকত, সেগুলোকে এক জায়গায় জমা করত। গরুর গোয়াল থেকে যে সব গোবর বা গৃহপালিত পশু-পাখির বিষ্ঠা আসত সেগুলোকে পচিয়ে জমিতে দিত, তারপরে ভালো ফসল হতো। ৬০ দশকের পর সার যখন বাজারে ইউরিয়া, নাইট্রেজেন, ফসফরাস এবং পটাশ আসে, তখন সার দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফসল উৎপাদন বাড়া শুরু হলো। ন্যানো পাটিের্কলের আকার অনুর চেয়ে সামান্য বড়। এটি ন্যানো মিটার দিয়ে পরিমাপ করা হয়। ১ ন্যানোমিটার সমান টেন টু দি পাওয়ার মাইনাস ৯ মিটার বা ১ বিলিয়ন অফ এ মিটার। বস্তুকে ভেঙে যখন অতটা ক্ষুদ্রতর পযাের্য় নেয়া হয় তখন তার কাযর্ক্ষমতা বহুলাংশে বেড়ে যায়, অনেকটা পারমাণবিক শক্তির মতো। বিসিএসআইআর-এর কয়েকজন বিজ্ঞানী প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব উদ্যোগে ন্যানো ফাটির্লাইজার তৈরির বিষয়ে গবেষণায় অনেক দূর এগিয়েছেন।

জমিতে কৃষকরা ম্যাক্রো নিউট্রিয়েন্ট হিসেবে রাসায়নিক সার (এনপিকে) নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাশিয়াম ব্যবহার করে। নাইট্রোজেনের জন্য ইউরিয়া, ফসফরাসের জন্য টিএসপি এবং পটাশিয়ামের জন্য পটাশ সার ব্যবহার করা হয়। যা জমিতে ছিটিয়ে ব্যবহার করতে হয় বলে মাত্র ৩০ থেকে ৩৪ ভাগ ব্যবহার হয়। আর শতকরা ৬০ থেকে ৭০ ভাগ অপচয়ের মাধ্যমে ক্ষেতের পাশ্বর্বতীর্ জলাশয় বা অন্যান্য পানির সঙ্গে মিশে পরিবেশের ক্ষতি সাধন করে থাকে।

আমাদের দেশের কৃষকরা মনে করে বেশি সার দিলে উৎপাদন বেশি হয়। ফলে তারা প্রয়োজনের অতিরিক্ত সার ব্যবহার করে থাকেন, ক্ষেতে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রায় ৭০ ভাগ সার গ্যাস আকারে উড়ে যাচ্ছে, অথবা মাটির নিচে লিচিং হয়ে চলে যাচ্ছে। মাটি ও পানিতে মিশে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। এতে একদিকে মাটির উবর্রতা নষ্ট হচ্ছে, আরেকদিকে এমোনিয়া আকাশে উড়ে গেøাবাল ওয়ামির্ংয়ের কারণে বায়ুমÐলের তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। তাহলে এ থেকে বের হওয়ার উপায়টা কি? তাহলে আমরা এভাবেই ইউরিয়া, ফসফেট ও পটাশ দেবো বা সার ব্যবস্থাপনা করব? গেøাবাল ওয়ামির্ং এড়াতেই নতুন টেকনোলজি ন্যানো ফাটির্লাইজার এনেছেন গবেষকরা।

আসুন জানা যাক ন্যানো ফাটির্লাইজার কীভাবে কাজ করে? এটা এমন একটি সার যেখানে ফসলের প্রয়োজনীয় অনেক পুষ্টি উপাদানকে অনেক কম মাত্রায়, একসঙ্গে মিশিয়ে উপাদানগুলোকে কম্প্যাক্ট করে পলিমারাইজড করা হয়। ফলে স্থায়িত্ব বেড়ে যায়। ফসলের গাছ দ্রæত এটা নিতে পারছে। এতে লাভ হচ্ছে একবার সার ব্যবহার করে দুই ফসল ফলানো যাচ্ছে। কেননা, আমাদের দেশে এক বছরে প্রায় দুই বা তিনটি ফসল হয়। এখন ফসলের জন্য একাধিকবার সার দিতে হয়, এতে আনুপাতিক হারে মাটি ও পানি দূষিত হচ্ছে। আবার এমোনিয়া আকাশে উড়ে, বায়ুমÐল দূষিত হচ্ছে। কৃষককে কিন্তু এগুলো কিনতে হচ্ছে। ভতুির্ক থাক আর যাই থাক, তারপরও উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। তাহলে উপায়টা কি? উপায় হচ্ছে এই ন্যানো ফাটির্লাইজার।

ন্যানো ফাটির্লাইজারের মাধ্যমে কম্প্যাক্ট নাইট্রোজেন, ফসফেট, পটাশ কিংবা অন্যান্য খাদ্য উপাদান পলিমারাইজড করে, গাছের গোড়ায় দিলে একবার ব্যবহার করে কমপক্ষে দুটো ফসল ফলানো সম্ভব। এটা আট মাস পযর্ন্ত রাখা যায়। তাহলে ফাটির্লাইজারে কিন্তু নতুন টেকনোলজি আসছে। এটা একটা বিষয়। দ্বিতীয়টি হলো এপ্লিকেশনের দিক দিয়ে বৈচিত্র্য আসছে। আমাদের দেশের কৃষক নাইট্রোজেন ফসফেট কিনে নিয়ে যায় বস্তা ধরে। তিনটা বস্তা নিল, নিয়ে গিয়ে ক্ষেতের পাশে একটা চট পেড়ে নিল। তার উপরে ঢেলে দিল, তারপর হাত দিয়ে মিশানো শুরু করল। এখন একটা ফসফেটের দানা একটা ইউরিয়ার দানার চেয়ে অনেক বড়। আবার একটা ইউরিয়ার দানা ফসফেটের দানার চেয়ে অনেক ছোট। আর পটাশিয়ামের দানাটা কৃস্টাল। তিনটাকে মিশানো হলো। ছড়ানোর সময় কি হলো, বড় দানাটা আগে হাতে আসবে, তাহলে যে এলাকাতে বড় দানাটা পড়ল, সেখানে ফসফেট বেশি পড়ল। তারপর আরেক পাশে ইউরিয়া বেশি পড়ল। পরের পাশে পটাশিয়াম বেশি পড়ল। একই ক্ষেতের মধ্যে, অথার্ৎ একটা কৃষকের ক্ষেত যদি বিশ শতক হয়, তার মধ্যে যদি তিন ভাগের এক ভাগে ফসফেট বেশি পড়ে, তারপর তিন ভাগের আরেক ভাগে ইউরিয়া বেশি পড়ে এবং তিন ভাগের অপর ভাগে পটাশিয়াম বেশি পড়ে, তাহলে কি হবে? ফলনের তারতম্য হবে।

ন্যানো ফাটির্লাইজার কিন্তু একটা নতুন টেকনোলজি। এটাকে কীভাবে কৃষকের কাছে কমিউনিকেট করতে হবে। ইদানিংকালে আমরা যেটা করেছি, বাংলাদেশে তো ফাটির্লাইজার আইন আছে, পলিসি আছে এবং এগুলোর একটা মানদÐ আছে। ন্যানো ফাটির্লাইজার হলো এখনকার সলিউশন বা সমাধান। ইতোমধ্যে ন্যানো ফাটির্লাইজারের টেস্ট ট্রায়েল শুরু করেছে বেসরকারি সংস্থা এসিআই লিমিটেড।

উদাহরণ হিসেবে ধরুন, চা বাগানের গাছগুলো আলাদা আলাদা থাকে। গাছের গোড়ায় যদি ৫০ গ্রামের গ্রানয়েল (ন্যানো ফাটির্লাইজার) দিয়ে দেয়া হয়, সেটা চায়ের যে লাইফ সাইকেল আছে অথার্ৎ উৎপাদনের সময়টা সাত আট মাস, এই পুরো সময়টা চা উৎপাদন করা যাবে। চা বাগানে সার ছড়িয়ে দিলে বৃষ্টি হলে পানিতে গড়িয়ে নিচে চলে যায়। অনেক সময় লিচিং হয় না, মাটিতে মেশে না। সে ক্ষেত্রে গাছের গোড়ায় ফাটির্লাইজারটা ঠিকমতো পেঁৗছাচ্ছে না। এই ন্যানো ফাটির্লাইজার চা বাগানে অনেক বেশি দেয়া লাগবে না। বেশিবার দেয়া লাগবে না এবং তার ফলনটা ঠিকই পাওয়া যাবে। এতে একদিনে একজন শ্রমিক এক একর জমিতে সার ছিটাতে যে পরিমাণ খরচ হয় তার অনেক কম খরচ হবে, বাড়তি লেবার লাগবে না, তেমনি বাড়তি সারও লাগবে না।

আরেকটি বিষয় হচ্ছে অগাির্নক ফাটির্লাইজার। আমাদের জমিগুলো প্রতিনিয়ত চাষবাসের কারণে কম্প্যাক্ট হয়ে যাচ্ছে। মাটির নিচে কিন্তু অক্সিজেন দরকার এবং মাটি ফঁাপা হওয়া দরকার। এ ক্ষেত্রে এখানে যদি অগাির্নক সার না দিই তাহলে কিন্তু জমির সমস্যা হবে। আমাদের দেশে কিন্তু অনেক কিছুর ওয়েস্টেজ হয়, যেমন কুসরের ছোবড়া, পাটকাঠি, বাড়ির আবজর্না, গোবর, মুরগির বিষ্ঠা সবকিছু মিলে কিন্তু অনেক ওয়েস্ট আছে। এই ওয়েস্টগুলোকে যদি আমরা সঠিক নিয়মে একসঙ্গে করে মাইক্রোবিল দিয়ে ট্রিট করতে পারি, তাহলে হবে কি এ সব ফাটির্লাইজার যেমন একদিকে মাটি ফঁাপা করবে। আরেকদিকে পানির রিটেনশন বাড়াবে। পানি ধারণক্ষমতা বাড়াবে। সঙ্গে সঙ্গে শিকড়ের সক্ষমতা বাড়াবে এবং গাছের যেসব উপাদান দরকার হয় তা সরবরাহ করবে। দেখা যাবে যে এই অগাির্নক ফাটির্লাইজার ব্যবহার করে মাটির উবর্রতা বাড়বে। অন্য সার প্রয়োগের পর এই সারগুলো গাছ নিতে পারবে। তাতে ফসলের ফলন অনেক বেড়ে যাবে।

ন্যানো টেকনোলজির প্রয়োগ বিশ্বব্যাপী শিল্পায়নের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। সে ক্ষেত্রে বিশ্বের উন্নত দেশের মতো ন্যানো ফাটির্লাইজার তৈরি করে তা দেশের কৃষকদের হাতে তুলে দিতে পারলে সাবির্ক উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে কৃষি ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী অগ্রগতি সাধিত হবে।

লেখক : ঊধ্বর্তন যোগাযোগ কমর্কতার্, ব্রি, গাজীপুর

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<29573 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1