বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১

শিক্ষক হয়েই বাঁচতে চাই

অন্যান্য দেশে সবচেয়ে মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় আসেন। অথচ আমাদের দেশে শিক্ষার প্রাথমিক স্তরে আসেন অন্য কোথাও কোনো ব্যবস্থা না হলে।
শাকিলা নাছরিন পাপিয়া
  ০৫ অক্টোবর ২০১৯, ০০:০০
শিক্ষক হয়েই বাঁচতে চাই

'গুরু' নামের সম্মানের পবিত্র শব্দটি কালেক্রমে 'শিক্ষক' হলো। 'শিক্ষক' আবার আধুনিক হতে হতে 'টিচার' হয়ে গেল। এই 'টিচার' আবার ভুল করে অথবা ছোটদের মুখে 'চিটার' হয় মাঝেমধ্যে।

শিক্ষার মূল ভিত্তি প্রাথমিক স্তর। শেষ ধাপ হিসাবে বিবেচিত বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের অপসারণের জন্য যখন ঝাড়ু মিছিল হয় তখন বিশ্লেষণ করে পুরো বিষয় আর বুঝিয়ে বলার অবকাশ থাকে না।

শৈশবের মা-বাবা-শিক্ষক তিনের সমন্বয়ে তৈরি এক মধুর জীবন। শাসন, আদর, ভালোবাসার এক অপূর্ব বন্ধন। অনেক অনেক বছর পর যখন ধুলোবালি ঝেড়ে জীবনের পিছনের পৃষ্ঠা উল্টায় মানুষ তখন স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করে শৈশবের প্রিয় শিক্ষকের অবয়ব, ভয়, ভালোবাসার এক মধুর সম্পর্ক। মনে হয় এই তো সেদিন। হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে সময়টাকে। মা-বাবা এবং শিক্ষক এই তিন ব্যক্তি তার নিজের চেয়ে সন্তান এবং শিষ্যকে বড় করে দেখতে চান। সুতরাং আধুনিক এবং উন্নত জীবনমান আমাদের অনেক কিছুই বদলে দিয়েছে। এই বদলের হাওয়ায় শিক্ষকের সাথে সম্পর্কটাও পাল্টে গেছে। পাল্টে গেছে শিক্ষকের ধরনও। বর্তমান সময় শিক্ষকের হাতে মার খেয়ে শিক্ষার্থীর হাসপাতালে ভর্তির কথা যেমন শোনা যায়, তেমনি শিক্ষার্থীর হাতে মার খেয়ে হাত-পা ভেঙে শিক্ষককেও হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকতে হয়।

৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস। শিক্ষকদের অবদানকে স্মরণ করার জন্য ১৯৯৫ সাল থেকে ৫ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী এই দিবসটি পালন করা হয়। বিশ্বের ১০০টি দেশে এ দিবসটি পালন করা হয়। এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল ও তার সহযোগী ৪০১টি সদস্য সংগঠন মূল ভূমিকা রাখে। এ দিবসটি উপলক্ষে ইআই প্রতিবছর একটি প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করে থাকে যা সচেতনতা বৃদ্ধির সাথে সাথে শিক্ষকতা পেশার অবদানকেও স্মরণ করিয়ে দেয়।

শিক্ষকদের অবদানকে স্মরণ করতে গিয়ে অনুপ্রেরণামূলক কিছু উদ্ধৃতি হলো-

১। একটি শিশুকে শিক্ষিত করে তোলা একটি বড় কাজ এবং সঠিকভাবে বলতে গেলে, একটি রাষ্ট্রশাসনের চেয়েও বড় কাজ।- উইলিয়াম এলাবারি, চ্যানিং (প্রাচারক ও ধর্মতত্ত্ববিদ)।

২। বেশির ভাগ লোককে ৫ থেকে ৬ জনের বেশি স্মরণ করে না। কিন্তু একজন শিক্ষককে হাজার হাজার মানুষ স্মরণ করে। - এ্যান্ডি রনি (সাংবাদিক)

৩। ব্রিলিয়ান্ট শিক্ষকের প্রতি লোকেরা সম্মানের দৃষ্টিতে তাকায়, কিন্তু কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকায় তাদের প্রতি, যারা আমাদের মানবিক অনুভূতিকে স্পর্শ করে। পাঠ্যক্রমটি নিতান্তই প্রয়োজনীয় কাঁচামাল কিন্তু আন্তরিকতা একটি ক্রমবর্ধমান উদ্ভিদ এবং একটি শিশুর আত্মার জন্য আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। - কার্ল জং (সুইস মনোবিজ্ঞানী)

আপনি যদি কাউকে পছন্দের তালিকায় রাখতে চান, তাহলে শিক্ষকদের রাখুন। তারা সমাজের নায়ক। - গাই কাওয়াসাকি (সিলিকন উপত্যকাভিত্তিক একজন লেখক, স্পিকার, উদ্যোক্তা এবং ধর্ম প্রচারক)।

পিতামাতা আমাদের পৃথিবীতে আনেন। সেই জীবনকে সুন্দর করে তোলেন, সে চোখে জ্ঞানের আলো দান করেন শিক্ষক।

সাহিত্য সমাজের দর্পণ। সাহিত্যে শিক্ষকের দিকে রুদ্ররোষে সমাজের দুর্জনের উক্তিতে- দম্ভ প্রকাশ পায়। অসৎ ব্যক্তি, ক্ষোভে ফেটে পড়ে বলেন, 'সামান্য স্কুল শিক্ষকের এত সাহস'? এই 'সামান্য' শব্দটি শিক্ষকের প্রতি অবজ্ঞা আর নষ্ট মানুষের আস্ফালন তুলে ধরে।

ব্রিটিশ থেকে পাকিস্তান, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ। সময় গড়িয়েছে অনেক। শাসনের পালা বদলে দেশটা এখন আমাদের। অথচ সেই যে 'পাদটীকা' গল্পের পন্ডিতমশাই তার ছাত্রদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করেছিলেন, বড় লাটের তিন ঠ্যাংওয়ালা কুকুরের কয় ঠ্যাংয়ের সমান সে আর তার পরিবার?- এ প্রশ্নের সমাধান আজও হয়নি। ব্রিটিশ আমলে স্কুল পরিদর্শনে হঠাৎ বছরে বা পাঁচ বছরে একদিন পরিদর্শক আসতেন। সারা গ্রামজুড়ে সে আগমনী বার্তা পৌঁছে যেত। পন্ডিতমশাইকেও তার গেঞ্জিটা গায়ে দিতে হতো অস্বস্তি নিয়ে।

আজও স্কুল পরিদর্শনে আসেন পরিদর্শকরা। সকাল-সন্ধ্যা পরিদর্শন হয়। বছর বছর পরিদর্শক বৃদ্ধি পায়। শিক্ষকদের একজন এভাবে বলেন তো অন্যজন ওভাবে। স্কুল, শিক্ষার্থী-শিক্ষকের কিন্তু সেখানে তার নিজের স্বপ্ন, সৃজনশীলতা নয়, কার্যকর করতে হয় উপরোস্ত কর্মকর্তার স্বপ্নকে। মানসম্মত শিক্ষার জন্য প্রতিনিয়ত বাড়ানো হচ্ছে শিক্ষকদের জন্য পাহারাদার। একটি দেশে শিক্ষকদের পাহারা দেয়ার জন্য অসংখ্য পাহারাদার যেখানে নিযুক্ত করতে হয় সেখানে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গোটা জাতিই যে চোর তা আর ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয় না।

যে দেশে তেল আর ঘি-এর দাম সমান সে দেশে জ্ঞানী-গুণীরা থাকতে নিষেধ করেছেন। বেতন-ভাতার জন্য এ দেশে শ্রমিক, কর্মচারীসহ নানা পেশার মানুষ রাজপথে আন্দোলন করে। শিক্ষকদেরও বেঁচে থাকার জন্য, সম্মানজনক বেতন-ভাতার জন্য আন্দোলনে নামতে হয়। তাহলে গুরুর মর্যাদা কোথায়? শহীদ মিনারে শিক্ষকদের দাবি মানার প্রতিশ্রম্নতি দিয়ে জুস পানে অনশন ভাঙানো হলো। একদিকে ক্যাসিনোর বস্তাভর্তি টাকা, বালিশ, পর্দার অবাককরা কান্ড, অন্যদিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য শিক্ষকদের বেতন যথেষ্ট। এটা নিশ্চিত প্রতারণা। কথা দিয়ে কথা না রাখা।

অন্যান্য দেশে সবচেয়ে মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় আসেন। অথচ আমাদের দেশে শিক্ষার প্রাথমিক স্তরে আসেন অন্য কোথাও কোনো ব্যবস্থা না হলে।

শিক্ষকতাকে অসম্মানিত অবস্থানে আনার জন্য কী কী দায়ী তা চিহ্নিত করা জরুরি। একদিকে শিক্ষক দিবস পালন, অন্যদিকে শিক্ষকদের জন্য অসম্মানজনক বেতন। একটি অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট এক ব্যক্তি বলেছিলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন লক্ষ টাকা হওয়া প্রয়োজন কিছু না পড়ালেও। কারণ তারা এতগুলো বাচ্চার চিৎকার সহ্য করেন।

ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা নিয়ে ভাইভায় বড় অংকের টাকা লেনদেন করে, দলীয় পরিচয়কে প্রাধান্য দিয়ে। যে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয় সে হয় নতজানু শিক্ষক। এই শিক্ষককে পাহারা দিতে আবার লাখ লাখ টাকা ব্যয়ে পাহারাদার নিযুক্ত করতে হয়। এ প্রসঙ্গে সেই গল্পটিই মনে পড়ে- রাজা দুধ খেতে বসে ভাবলেন, গোয়ালা কি দুধে পানি মেশায়? ফলে, একজন কর্মচারী নিয়োগ করলেন দুধ পরীক্ষার জন্য। কর্মচারী গোয়ালার কাছে দুধ দাবি করল। নইলে বলবেন, দুধে পানি মেশানো হয়। সুতরাং গোয়ালা যে পরিমাণ দুধ কর্মচারীকে দিলেন সে পরিমাণ পানি মিশিয়ে তার দুধের পরিমাণ ঠিক করলেন। এভাবে দুধ পরীক্ষার জন্য কর্মচারী বাড়ে দুধে পানিও বাড়ে। অবশেষে একদিন দুধের মধ্যে একটি চিংড়ি মাছ পাওয়া গেল। রাজা গোপালকে প্রশ্ন করলেন, দুধে চিংড়ি মাছ কেন? গোপাল উত্তর দিল, তদন্ত কর্মকর্তা আরও বাড়লে এরপর কুমীর পাওয়া যাবে।

আমাদের শিক্ষায় কুমীর পাওয়ার অবস্থা। মানসম্মত শিক্ষার জন্য প্রয়োজন মানসম্মত শিক্ষক। মেধা, মনন এবং নৈতিকতা। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে এই তিনটিই গুরুত্বপূর্ণ। সেই সঙ্গে প্রয়োজন শিক্ষকের জন্য ঈর্ষণীয় জীবনমান। ম্যানেজিং কমিটির আস্ফালন, কর্মকর্তাদের মানসিক নির্যাতন, নানা ধরনের কাজের চাপ সব মিলিয়ে শিক্ষকতা পেশা এ দেশে মানসিক নির্যাতনমূলক একটি পেশা। অতীতে টাকা না থাকলেও সম্মান ছিল। এখন টাকা এবং সম্মান কোনোটিই নেই। কিছুদিন আগে সভাপতিকে দেখেছি জুতা দিয়ে শিক্ষককে মারতে গেছেন। এক শিক্ষিকাকে পিটিয়ে হাত-পা ভেঙে দিয়েছে তারই ম্যানেজিং কমিটির সদস্য। এরকম ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। বেশি বেশি একই ঘটনা ঘটলে তা সহ্য হয়ে যায়। আমাদের এখন এসব কিছুই মনে হয় না।

শিক্ষকদের আন্দোলন অপেক্ষায় জল ঢেলে দিয়ে যখন বলা হয়েছে প্রাথমিকের শিক্ষকরা যথেষ্ট বেতন পান তখন শিক্ষকদের নতুন করে ভাবা প্রয়োজন। বলা হয়েছে, শিক্ষকদের প্রমোশন দেয়া হবে। এটা একটা ফাঁদ।

শিক্ষক দিবসে আলোচনা, সেমিনার হবে। এটা শিক্ষকদের সম্মান জানানোর জন্য বিশেষ দিন সেটাও বলা হবে। কিন্তু এই দিন এমনকি কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে যা শিক্ষকদের বর্তমান অসম্মান আর দরিদ্রতাকে দূর করে তাদের হারানো সম্মান ফিরিয়ে দেবে? শিক্ষককে ব্যবসায়ী থেকে শুধুই শিক্ষক তৈরি করার কোনো পরিকল্পনা কি রাষ্ট্রের আছে?

মন্ত্রী, সচিব মহোদয় প্রায়ই প্রাথমিকের শিক্ষকদের বলেন, আপনাদের পায়ে ধরে কেউ এ পেশায় আনেনি। জেনেশুনেই এসেছেন।

একজন শিক্ষক হিসেবে বলতে চাই, আমরা দয়া করে এ পেশায় থাকছি। এ পেশার গুরুত্ব, সম্মান, মর্যাদা যদি এ রাষ্ট্র বুঝতে অক্ষম হয় তা হলে এটা জাতি হিসেবে লজ্জার। আমরা জাতির এ লজ্জাকে মুছে দিয়ে এ পেশার মান সমুন্নত রাখতে সচেষ্ট থাকব।

হাজারটা না পাবার মধ্যেও যারা তাদের জীবনের পুরোটাই এ পেশায় আলো জ্বালাতে ব্যয় করলেন, তাদের জন্য কোনো পুরস্কার কি আজ এই দিনে থাকতে পারত না? তেলের বিনিময়ে নয়, গোপান তথ্যের বিনিময়ে, পিটিআই। স্থানীয় জনগণ, সার্ভিস বুক নানা স্থানের তথ্য সংগ্রহ করে প্রতি জেলা থেকে একজন শিক্ষককে খুঁজে বের করে শিক্ষক দিবসে একটি সম্মানজনক আর্থিক পুরস্কার কি এ রাষ্ট্র তুলে দিতে পারত না?

এ রাষ্ট্র আমার কাছে জানতে চায়নি আমার চাওয়ার কথা, মিডিয়া আমায় ডাকেনি আমার স্বপ্নের কথা জানতে তারপরও নষ্ট সময়ে, নষ্টদের ভিড়ে দাঁড়িয়ে আমি বলতে চাই- আমি শিক্ষক। এটা চাকরি নয়, পেশা, আমায় আমার প্রকৃত সম্মান এবং সম্মানি দিতে ব্যর্থ রাষ্ট্রকে দয়া করে এ পেশায় আমি আছি। আমার ওপর চাপিয়ে দেয়া নানা কাজ আমি করি, আমার ওপর খবরদারি করা, আমায় তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী করে রাখা নানা অসম্মানে আমি চুপ করে থাকি। কারণ আমি অপেক্ষা করি অর্জুনের মতো কোনো বীরের আগমনের জন্য, আমি স্বপ্ন দেখি একলব্যের মতো কোনো শিষ্যের গুরুদক্ষিণার জন্য। আমি কর্মকর্তা নই, শিক্ষক হয়েই বাঁচতে চাই। অন্যায় ক্ষমতা, নষ্ট মানুষের ভয়ে মাথানত করা শিক্ষক নয়, স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে স্বপ্ন দেখা, মানুষের মনে আলো জ্বালিয়ে অন্ধকার দূর করা, উন্নত শিরে দৃঢ়তার সঙ্গে কথা বলা একজন শিক্ষক হয়ে বাঁচতে চাই। শিক্ষক দিবসে সব শিক্ষকের পক্ষ থেকে এটাই হোক চাওয়া।

শাকিলা নাছরিন পাপিয়া: কবি, কথাসাহিত্যিক, শিক্ষক ও কলাম লেখক

\হ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<69638 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1