শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু

মো. এনামুল হক
  ২০ মার্চ ২০২০, ০০:০০

মধ্য আগস্ট, ১৯৪৭। ভারতবর্ষ স্বাধীন হলো। ভারতবর্ষ দ্বিখন্ডিত হলো। জন্ম নিল দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র। ভারত ও পাকিস্তান। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলো। মুসলিম জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ভারতবর্ষের পূর্ব ও পশ্চিমের মুসলিম অধু্যষিত সম্পূর্ণরূপে পৃথক দুটি ভূখন্ড (বর্তমানের বাংলাদেশ ও পাকিস্তান) নিয়ে গঠিত হলো নতুন রাষ্ট্র- 'পাকিস্তান'। বাঙালি মুসলমানরা ভাবলেন, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, মুসলমানরা এখন বাঙালি-অবাঙালি নির্বিশেষে নিজেরা নিজেদের ভাগ্য গড়বে। দেশকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলবে। বঙ্গবন্ধুও তাই ভাবতেন। তিনি তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, 'আমি ভাবতাম, পাকিস্তান কায়েম হয়েছে, আর চিন্তা কি?' কিন্তু পাকিস্তান হওয়ার পর পরই শুরু হলো ষড়যন্ত্র। ষড়যন্ত্র শুরু হলো পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষাকে কেন্দ্র করে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সরকার উর্দুকেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার অপচেষ্টা চালায়। খাজা নাজিমুদ্দীনসহ পূর্ব বাংলার কতিপয় বাঙালি মুসলিম লীগ নেতাও তাদের সঙ্গে হাত মেলান। এমতাবস্থায় সাতচলিস্নশের ডিসেম্বরে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। অতঃপর ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রম্নয়ারি করাচিতে পাকিস্তান সংবিধান সভার (কন্সটিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি) অধিবেশন বসে। সে অধিবেশনে পাকিস্তান সংবিধান সভার সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত (কংগ্রেস সদস্য, কুমিলস্না) উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন করেন। কিন্তু মুসলিম লীগ নেতারা তা প্রত্যাখ্যান করেন। এমতাবস্থায় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিশ যুক্তভাবে সর্বদলীয় সভা আহ্বান করে রাষ্ট্রভাষা বাংলা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে। এই সংগ্রাম পরিষদ ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চকে 'বাংলা ভাষা দাবি' দিবস ঘোষণা করে। সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক বঙ্গবন্ধু ফরিদপুর, যশোর, দৌলতপুর, খুলনা ও বরিশাল জেলা গিয়ে দিবসটি যথাযথভাবে পালনের জন্য ছাত্রদের সংগঠিত করেন। এসব জেলায় ছাত্রদের সংগঠিত করে তিনি ৮ মার্চ ঢাকা ফিরে আসেন। তারপর ১১ মার্চ ঘোষিত কর্মসূচি পালনকালে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। এরপর ১১ থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত লাগাতার ধর্মঘট পালনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। এতে সরকার বেশ বেকায়দায় পড়ে। অতঃপর ১৫ মার্চ সরকার ও রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের মধ্যে আট দফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ফলে রাষ্ট্রভাষার ইসু্যটি কিছুদিনের জন্য স্তিমিত হয়ে পড়ে।

এরপর ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন পল্টন ময়দানে বক্তৃতাকালে বললেন, 'উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে।' তিনি ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে যে আট দফা চুক্তি করেছিলেন এ ঘোষণা ছিল তার পরিপূর্ণ বরখেলাপ। উলেস্নখ্য, পূর্ব বাংলার অফিসিয়াল ভাষা বাংলা হবে মর্মে তিনি নিজেই পূর্ব বাংলা আইনসভায় প্রস্তাব পেশ করেছিলেন এবং তা পাসও হয়েছিল।

সে সময় বঙ্গবন্ধু বন্দিদশায় ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন ছিলেন। বাংলা ভাষাকে নিয়ে আবার বিরাট ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। বুঝতে পেরে তিনি গভীর রাত্রে নিরাপত্তাকর্মী ও গোয়েন্দাদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে গোপনে আলোচনা ও শলাপরামর্শ করেন। এতে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সমন্বয়ে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে আন্দোলন করার সিদ্ধান্ত হয়। সে মোতাবেক মাওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে ঢাকা বার লাইব্রেরিতে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় কর্মিসভায় কাজী গোলাম মাহবুবকে আহ্বায়ক করে ৪০ সদস্যবিশিষ্ট সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়।

মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার এসব রাজনৈতিক তৎপরতার কথা কর্তৃপক্ষ টের পেয়ে যায়। তাই তাকে মেডিকেল থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রেরণ করা হয়। যদিও তিনি তখনো পুরোপুরি সুস্থ হননি। এ সময় জেল থেকে তিনি আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে গোপনে চিরকুট পাঠিয়ে পরামর্শ প্রদান করতে থাকেন। সরকার তা টের পেয়ে ১৫ ফেব্রম্নয়ারি তাকে ঢাকা থেকে ফরিদপুর জেলে স্থানান্তর করে। সেখানে তিনি আমরণ অনশন শুরু করেন।

সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ২১ ফেব্রম্নয়ারি প্রদেশব্যাপী ধর্মঘট পালন এবং বিক্ষোভ প্রদর্শনের কর্মসূচি ঘোষণা করে। কিন্তু সরকার সেদিন ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে সব ধরনের মিছিল, শোভাযাত্রা ও সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ছাত্ররা সরকারের এ নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ২১ ফেব্রম্নয়ারিতে শোভাযাত্রা বের করে। পুলিশ তার ওপর গুলি চালায়। ফলে ভাষার দাবিতে ঢাকার রাজপথ বাঙালির রক্তে রঞ্জিত হলো। পরের দিনও বাঙালিদের বুকে গুলি চলে। এতে মোট ৯টি তরুণ প্রাণ অকালে ঝরে পড়ে। রক্তাক্ত এ ঘটনায় ভাষা আন্দোলন ব্যাপকভাবে গণসম্পৃক্ততা লাভ করে। সর্বস্তরের জনগণ এ রক্তপাতের পর ভাষা আন্দোলনকে সমর্থন জানায়। ২১ ফেব্রম্নয়ারির রক্তাক্ত ঘটনাবলি পাকিস্তান মুসলিম জাতীয়তাবাদের বিপরীতে একটি স্বতন্ত্র বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে। আর এই বাঙালি জাতীয়তাবাদের পথ বেয়ে আসে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা।

ভাষা আন্দোলনের দুই বছর পর ১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলা আইন পরিষদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে বাঙালিরা নিজেদের স্বার্থ রক্ষার্থে কৃষক-শ্রমিক পার্টি (কেএসপি), আওয়ামী লীগ, নেজামে ইসলাম ও গণতন্ত্রী দলের সমন্বয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে। মহান ভাষা আন্দোলনের অমর একুশকে স্মরণীয় করে রাখার উদ্দেশ্যে যুক্তফ্রন্ট ২১ দফা নির্বাচনী কর্মসূচি ঘোষণা করে। এ নির্বাচনে পূর্ব বাংলায় নয়টি বাদে সব কটি আসনেই যুক্তফ্রন্ট প্রার্থীরা বিপুল ভোটাধিক্যে জয়লাভ করে। নির্বাচনে জয়লাভ করে এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে ২ এপ্রিল যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু সে মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে শপথ নেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার ষড়যন্ত্র করে সে মাসেই যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বাতিল করে কেন্দ্রীয় শাসন জারি করে। নির্বাচনে জয়লাভ করার পরও এভাবে বাঙালিদের ক্ষমতায় থাকতে দেওয়া হয়নি।

অতঃপর দেশটির জন্মের ৯-১০ বছর প্রথমবারের মতো ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হয়। তবে তাতে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি। ফলে জনগণ কর্তৃক তা প্রত্যাখ্যাত হয়। এমতাবস্থায় ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করে সামরিক শাসন জারি করেন। ১৯৫৬ সালের সংবিধান বাতিল করেন। অতঃপর তথাকথিত মৌলিক গণতন্ত্রীদের নিয়ে ১৯৬০ সালের ১৪ ফেব্রম্নয়ারি গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। গণভোটের ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে তিনি ১৭ ফেব্রম্নয়ারি

পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। এরপর তিনি ১৯৬২ সালের ১ মার্চ একটি নতুন সংবিধান ঘোষণা করেন। তবে সে সংবিধানেও জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি। ফলে সে সংবিধানও জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়। এরপর ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে শরিফ শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বিরোধী এবং ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বিরোধী ব্যাপক ছাত্র বিক্ষোভ হয়। এসব ঘটনাপ্রবাহের ফলে বাঙালিদের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তান বিরোধী মনোভাব দানা বেঁধে উঠতে থাকে।

এরই মধ্যে পাকিস্তানের দুই অংশ তথা তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিশাল বৈষম্যের সৃষ্টি হয়। বাঙালিরা সর্বক্ষেত্রে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। তারা পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক শোষিত ও বঞ্চিত হতে থাকে। পূর্ব বাংলার সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হতে থাকে। বিদেশি ঋণ ও প্রকল্প সহায়তা মূলত পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিতে ব্যয়িত হয়। চাকরি-বাকরি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও বাঙালিরা তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৫৬ ভাগ ছিল বাঙালি। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সচিবালয়ে ১৭ জন সচিবের মধ্যে মাত্র ২ জন ছিল বাঙালি। ১৯৬৫ সালের দিকে কেন্দ্রের বেসামরিক চাকরিতে বাঙালির হার ছিল ২৪% মাত্র। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানের ১৭ জন জেনারেলের (জেনারেল, লে. জেনারেল ও মেজর জেনারেল) মধ্যে বাঙালি ছিল মাত্র ১ জন। স্থলবাহিনী, বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীতে অফিসার পদে বাঙালির হার ছিল যথাক্রমে ৫%, ১৬% ও ১০%।

১৯৫০-৬৯ মেয়াদে পাকিস্তান সর্বমোট ৫৬৮৩ মিলিয়ন ডলার বৈদেশিক সাহায্য লাভ করে। তার মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে ব্যয় হয়েছিল মাত্র ১৯৪১ মিলিয়ন ডলার অর্থাৎ প্রাপ্ত সাহায্যের ৩৪% মাত্র। ১৯৪৮-৪৯ থেকে ১৯৬৮-৬৯ পর্যন্ত সময়ে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ৪১৯ কোটি টাকার সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হয়। পাকিস্তানের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বিনিয়োগ করা হয় যথাক্রমে ২৬%, ৩২% ও ৩৬%।

সর্বক্ষেত্রে এই শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় হিসেবে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে কেবল মুদ্রা, বৈদেশিক বিষয় ও প্রতিরক্ষার মতো বিষয়গুলো রেখে বাকি সব ব্যাপারে প্রাদেশিক সরকারের কর্তৃত্বের দাবি সংবলিত বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসনের রূপরেখা দেওয়া হয়েছিল ছয় দফা দাবিনামায়। পূর্ব বাংলার বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসনের দাবি সংবলিত এ কর্মসূচিকে বাঙালি জাতির মুক্তির একমাত্র সনদ বিবেচনা করে জনগণ শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগে ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। এর ফলে দ্রম্নতই পূর্ব বাংলার বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসনের দাবি তীব্রতর হয়ে ওঠে। ছয় দফা দাবিনামা পেশ করার পর শেখ মুজিবুর রহমান ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তার অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তায় পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন শাসকচক্র ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে তারা তাকে ও তার দলের নেতাদের কারারুদ্ধ করে। শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে আগরতলা মামলা দায়ের করা হয়। পূর্ব বাংলার মানুষ বিশেষ করে সচেতন ছাত্রসমাজ এ প্রহসন ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে। ইতোমধ্যেই ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া), ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) ও এনএসএফের একাংশকে নিয়ে গঠিত ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ তাদের ১১ দফা দাবি সংবলিত কর্মসূচি পেশ করে। ৬ দফা ও ১১ দফার ভিত্তিতে ১৯৬৮-৬৯ সালে পূর্ব বাংলায় গড়ে ওঠে ব্যাপকভিত্তিক গণআন্দোলন। গণআন্দোলন রূপ নেয় গণঅভু্যত্থানে। দেশব্যাপী অপ্রতিরোধ্য এ বিক্ষোভ ও গণঅভু্যত্থানের মুখে দোর্দন্ডপ্রতাপশালী স্বৈরশাসক স্বঘোষিত ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান মাথা নত করতে বাধ্য হন। তিনি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে নেন। শেখ মুজিবুর রহমানসহ সব রাজবন্দিকে মুক্তি দান করেন। অবশেষে ২৫ মার্চ সেনাবাহিনীপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করে তিনি বিদায় নেন।

অতঃপর ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে পূর্ব বাংলায় জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টিতে আওয়ামী লীগ জয় লাভ করে নির্বাচনী ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব নজির সৃষ্টি করে। আওয়ামী লীগ একে ছয় দফার প্রতি জনগণের ম্যান্ডেট বা গণরায় বলে ঘোষণা করে। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বিশেষ করে ক্ষমতাসীন সামরিক জান্তা নির্বাচনের এ ধরনের ফলাফল মেনে নিতে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। ফলে আবার শুরু হয় ষড়যন্ত্র। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করেন। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বানে গড়িমসি করতে থাকেন। জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার ঘনিষ্ঠ সহকর্মীবৃন্দ তা উপলব্ধি করে অবিলম্বে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করার জন্য ইয়াহিয়া খানকে চাপ দিতে থাকেন।

এমতাবস্থায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ, ৭১ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন। যদিও পর্দার অন্তরালে গোপন শলাপরামর্শ ও ষড়যন্ত্র ঠিকই চলতে থাকে। মার্চের প্রথম দিনটিতেই তিনি ৩ মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। তার এ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই সারা বাংলাদেশ দপ করে জ্বলে ওঠে। দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে তার লেলিহান শিখা। এমতাবস্থায় বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ বজ্রদীপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেন, এবারের সংগ্রাম- আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম- স্বাধীনতার সংগ্রাম। এদিন তিনি স্বাধীনতার কৌশলী ঘোষণাও দেন। সেই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের রূপরেখাও ঘোষণা করেন। এরপর কয়েক দিনের নাটকীয় ঘটনাপ্রবাহের পর তিনি ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। অতঃপর শুরু হলো বাংলাদেশের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ এবং ১৬ ডিসেম্বর আমরা পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করে বিজয় অর্জন করলাম।

১৯৬০ দশকের মধ্যভাগের স্বায়ত্তশাসনের দাবি সেই দশকেরই শেষার্ধে গিয়ে স্বাধিকার আন্দোলনে পরিণত হয়। আবার স্বাধিকার আন্দোলন একাত্তরের প্রারম্ভে স্বাধীনতা সংগ্রামে রূপান্তিত হয়। আর এসব আন্দোলন-সংগ্রামে সর্বসম্মুখে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু।

মো. এনামুল হক: মহাব্যবস্থাপক (অব.) বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<93231 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1